আমার দুটি মামলার জামিন হয়েছে। আর একটি মামলার জন্য আমি কারাগার থেকে মুক্ত হতে পারছি না। পল্টন – ৩৪ (১০) ২১ নং মামলা। এই মামলার জামিন হলেই আমি কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাবো। প্রায় এগারো মাস ধরে কারাবন্দী। বাইরে বের হবার ইচ্ছা প্রায় এখন শেষ হয়ে গেছে। কারাগার হয়ে গেছে ঘর – বাড়ী। আমার যে চাকরি ছিলো সেটা চলে গেছে প্রায় এগারো মাস আগেই। যেই রুমে থাকতাম সেই রুমে রাখা পরনের কাপড় সহ যাবতীয় জিনিসপত্র ছোট ভাইকে ফোন করে বলে দিয়ে আনিয়ে রাখলাম।এভাবে আরো দুই মাস কেটে গেলো। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরুতে আমার পল্টন থানার মামলাটির জামিন হয়।
সকাল ১০ টায় জামিনের বেল আসে। বেল আসার সাথে সাথে চলে গেলাম জামিন টেবিলে। আমার কেসকার্ডে রাজনৈতিক মামলার আসামী দেখে প্রায় দুই ঘণ্টা জামিন টেবিলে বসিয়ে রাখলো। দুই ঘণ্টা পর নিয়ে গেলো জেল গেটে। সেখানে আরো বেশ কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখার পর এসবি ( পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ) র একজন সদস্য কাছে ডেকে বললেন, রাজনৈতিক মামলা। বাইরে বের হবার পর আবার ভেতরে ঢুকিয়ে দেবে। তার চেয়ে বরং কিছু খরচ করুন। বাইরে যাবার ব্যবস্থা আমরা করে দিচ্ছি। কিন্তু আমার কাছে তখন কিছু খুচরা টাকা ছাড়া আর কিছু ছিল না।
পকেট থেকে বের করে দেখিয়ে বললাম আমার কাছে এই টাকা ছাড়া আর কোন টাকা নেই।এসবির একজন বললেন,বাইরে বের হবার পর জোগাড় করে দিতে পারবো কিনা? বললাম, বাড়িতে ফোন দিয়ে যদি কেউ আসে তবে চেষ্টা করে দেখবো। সন্ধ্যা যখন প্রায় ছুঁই ছুঁই তখন আমার সব কাগজ দেখে আমাকে ছাড়া হলো। বাইরে বের হবার পর এসবির একজন সদস্য তার মোবাইল থেকে আমার ছোট ভাইয়ের নাম্বারে ফোন দিলো। ছোট ভাইকে বললাম কারাগারের বাইরে মূল ফটকে থাকতে। আমি মূল ফটকের বাইরে একটা চায়ের দোকানে বসলাম। এসবির লোকজন বুঝতে পারলো আমার পেছনে সময় নষ্ট করে লাভ হবে না। কিছু পাওয়া যাবে না। তাই তারা অন্য ধান্দায় চলে গেলো। দীর্ঘ তেরো মাস জেলবন্দী থেকে আমি পথহারা। শারীরিক ও মানসিক উভয় অবস্থারই অবনতি ঘটেছে। এখন যেভাবে মুক্ত মনে সব লিখতে পারছি তখন কথা বলার স্বাভাবিক ভাষাটাও হারিয়ে ফেলেছিলাম। ঘণ্টাখানেক পর ছোট ভাই জেলের বাইরের মূল ফটকে এলো। বড় বোনের বাসায় কয়েকদিন অবস্থান করেছিলাম ঠিকই। কিন্তু আবার অসুস্থ হয়ে পড়লাম। কিছু চিকিৎসা করানোর পর বাড়ি চলে গেলাম। কারাগারে ও মানসিক হাসপাতালে বসে বেশ কিছু কবিতা লেখা হয়েছিল। কয়েকটা ছোট গল্প লিখেছিলাম। কিন্তু দীর্ঘ তেরো মাস জেলবন্দী থেকে অনেক কিছু শিখেছি এবং যে জিনিসটা হারিয়েছি তা হলো সময়। এভাবে অনেক সময় মানুষের জীবন থেকে হারিয়ে যায়। আমারও অনেক সময় হারিয়ে গেছে। সামনের দিনগুলো যেন এভাবে হারিয়ে না যায় সেই চেষ্টায় নিয়োজিত আছি। যে মামলায় আমাকে এরেস্ট করা হয়েছিল সেটি ২০২১ সালের আলোচিত ধর্মীয় দাঙ্গার মামলা। এই লেখাটিতে আমি আমার জেল হাজতের অভিজ্ঞতার কথাগুলো লিখে গেছি।
পরবর্তীতে ২০২১ সালের ধর্মীয় দাঙ্গা বিষয়ে বিস্তর আলোচনা করবো। পৃথিবীর সকল মানুষের শান্তি ও সুস্থতা কামনা করে আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি।