স্রষ্টা সকল মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।
স্রষ্টা মুসলিমদেরও সৃষ্টি করেছেন।
অতএব স্রষ্টা অমুসলিমদেরও সৃষ্টি করেছেন।
এখন স্রষ্টার অস্তিত্ব থাকলেই কেবল এই যুক্তি সিদ্ধ হবে। এই যুক্তি অনুমান নির্ভর। এবং এটা এই নিহিতার্থ বহন করে না যে, স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে। কেবল বলা যায় পৃথিবীতে মুসলিমরাও আছে, অমুসলিমরাও আছে। এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞানের অবস্থান কোথায়? এটা নির্ভর করবে এর মানের উপর। স্রষ্টার প্রমাণ আমরা পাই ধর্মগ্রন্থে। স্রষ্টার চাক্ষুস সাক্ষাৎ কেউ পাননি। ইহুদী মত বলে, স্রষ্টা তুর পাহাড়ে এসেছিলেন বলে তা পুড়ে গিয়েছিল। এর মানে স্রষ্টার সাথে প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ অসম্ভব। দ্বিতীয় তথ্য আছে মুসলিমদের কোরআনে। সেখানে নবী মোহাম্মদ সা. সপ্তম আসমানে- আরশে গিয়েছিলেন। কিন্তু সরাসরি মুখ-দর্শন হয়নি। স্রষ্টা তেজ ঢাকতে পর্দার ওপাশেই ছিলেন। ফলে কণ্ঠ শুনলেও সাক্ষাৎ হয়নি। এই দুটি ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হল— তৃতীয় কোন সাক্ষী নেই। তুর পাহাড়ে মুসা আ. একাই গিয়েছিলেন। নবীদের সাথে একা বহু ধরনের ঘটনাই ঘটেছে। যেমন ইব্রাহিম আ. তার পুত্রকে কোরবাণী দিতে পাহাড়ে একাই নিয়ে গিয়েছিলেন। এবং সেখানে দুম্বা কোরবাণী হওয়ার তৃতীয় কোন সাক্ষী নেই। মেরাজেও নবী মোহাম্মদ সা. একাই গিয়েছিলেন। ইহুদী ও মুসলিমদের শুধু তাদের নবীর উপরই বিশ্বাস করতে হচ্ছে। যদি তারা সত্য বলেন তাহলেই সত্য হতেও পারতো। কিন্তু মানুষেরতো বিভ্রমও হয়। আমরা যা দেখি সব সময় তা সত্য নয়। যেমন আমরা সূর্যকে ডুবে যেতে দেখি, যা থেকে ধর্ম গ্রন্থে এসেছে সূর্য কর্দমাক্ত জলাশয়ে অস্ত যায়। কিন্তু এটা এখন প্রমাণিত যে, সূর্য কোথাও অস্ত যায় না। স্রষ্টার অস্তিত্বের এখন সবাই প্রমাণ চাইবে। সেটা যদি থাকে তবেই ঐ যুক্তি সত্য হবে। আরেকটি যক্তি দেই-
সকল মানুষ মরণশীল
আমি একজন মানুষ
অতএব আমিও মরণশীল।
এই যুক্তির সবগুলোই আমর চাক্ষুস দেখি। পৃথিবীর কোন মানুষেরই দেড়শ বছরের বেশি বেঁচে থাকার প্রমাণ নেই। ধর্মগ্রন্থে দেখা যায় কোন কোন নবী হাজার বছর বেঁচেছিলেন। এটা বিশ্বাস। এটা মেনে নিলেও সাধারণ অর্থে বলা যায় মানুষ মরণশীল। ব্যতিক্রম আছে কেবল ধর্মগ্রন্থে। যেমন ইসা আ.কে স্রষ্টা পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং তিনি আবারো আসবেন। মানে হল তিনি মারা যান নি। ঈশ্বরের পুত্রকে হয়তো ঈশ্বর তার নিজের কাছেই রেখেছেন। মুছা আ. এর সাথে মুসলিমদের নবী মোহাম্মদ সা. এর সাক্ষাৎ প্রমাণ করে তিনিও মারা যাননি। হিন্দু ধর্মের দেব-দেবীরাতো এখনো হিমালয়ে আছেন! যদিও এসবেরও প্রমাণ নেই। এটা সত্য যে, আমাদের সামনে দেড়শো বছরের বেশি বয়সকাল ধরে বেঁচে থাকা কেউ এখন আর নেই। দুই শ বছর ধরলে কোন বিতর্কই উঠবে না। এর মানে সব মানুষই এখন পর্যন্ত মরণশীল। তাই ধরে নিতে হচ্ছে আমিও একজন প্রমাণিত মানুষ হিসেবে মরণশীলই হবে। এটা ভাল যুক্তি কিন্তু যুক্তি প্রায়শই কুযুক্তি হয়ে তা ফ্যালাসিতে পরিণত হয়। একটি উদাহরণ দিতে পারি-
নির্বাণ লাভ হচ্ছে মৃত্যু
সুখ হচ্ছে নির্বাণ লাভ
অতএব মৃত্যু হচ্ছে সুখ!
এখানে প্রথম দুটি বাক্যে যুক্তির ধারাবাহিকতা নাই। ফলে এ ধরনের যুক্তিকে আমরা ফ্যালাসি বলতে পারি। এগুলো হচ্ছে যুক্তির ভান করে মিথ্যা বা অযৌক্তিক কিছু সত্য বলে চাপিয়ে দেয়া। এমন চালাকি করেই আমরা ধর্ম ব্যবসায়ীদের দেখি সাধারণকে ঠকিয়ে তাদের পকেটের টাকা নিজেদের পকেটে নিতে। আরেকটি কুযুক্তি দেই-
মাতা মেরী শুক্রাণু ছাড়াই মা হয়েছেন
মাতা মেরী একজন কুমারী নারী
অতএব কুমারী নারীরা শুক্রাণু ছাড়াই মা হতে পারেন।
মাতা মেরী শুক্রাণু ছাড়াই মা হয়েছেন এটা বিশ্বাস। এখনো পৃথিবীতে অহরহই বিয়ে না করেই নারী মা হচ্ছেন। কিন্তু এই যুক্তিতে আজ আর কেউ মানবে না যে, ওই নারীর সাথে গোপনে কোন পুরুষের শারীরিক সংষর্গ ঘটেনি অথবা তিনি ফ্রিজিং শুক্রাণু গ্রহণ করেননি। কিন্তু কুমারী মাতা মেরী অলৌকিক ক্ষমতা বলে মা হননি তা প্রমাণ করা এখন সম্ভব নয়। পারিপার্শ্বিক যুক্তি দিয়ে আমরা বলতে পারবো এটা অসম্ভব। এই সুযোগে কেউ দাবী করবেই যে, কুমারী মাতা ঈশ্বর দ্বারাই গর্ভবতী হয়েছিলেন। এখনো আমরা অনেক কিছুই জানি না। আমাদের জানার সীমাবদ্ধতার কথা বলেই অনেকে কুযুক্তি উত্থাপন করেন। দরিদ্র দেশগুলোর কতিপয় কথিত জ্ঞানী ব্যক্তিও অলৌকিক সত্তায় বিশ্বাস করেন। যেমন আমাদের পদার্থবিদ আল্লামা শমশের আলী এবং অরুণ বসাক স্যারের কথা বলতে পারি। অরুণ বসাক স্যারকে নিয়ে একটি কুযুক্তিও দাঁড় করাতে পারি—
পদার্থ বিজ্ঞানী অরুণ বসাক আংটি পরেন
আংটি তার মনে প্রশান্তি এনেছে ও রোগ সারিয়েছে
অতএব আংটি একটি মহোষুধ।
অরুন বসাক স্যার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর অজ্ঞতা থেকেই আংটি পরেন। এই অজ্ঞতাকেই আংটি ব্যবসায়ীরা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ হিসেবে যুক্তি উত্থাপন করেন। কিন্তু পৃথিবীর ৯৩-৯৭% মানুষ যে শুধু আংটিই নয়, অলৌকিক স্রষ্টাতেই বিশ্বাস করেন না সেটা তারা আড়ালে রাখেন। আরেকটি কুযুক্তি দেই—
পৃথিবীর ১০০ কোটি মানুষ হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী
হিন্দু ধর্ম মিথ্যা হলে এতো মানুষ বিশ্বাস করতো না
অতএব হিন্দু একটি সত্য ধর্ম।
এই কুযুক্তির বিরুদ্ধে বিস্তর উদাহরণ দেয়া যায়। কিন্তু ধর্ম ব্যবসায়ীরা এ ধরনের যুক্তি যাদের কাছে উত্থাপন করেন তারা কিন্তু কুযুক্তিটা ধরতে পারেন না। তারা সায় দেন। মুসলিম, খ্রীস্টান, বৌদ্ধ, শিখ ইত্যাদি ধর্মের মানুষও এমন কুযুক্তি উত্থাপন করে। মুসলিমরা দাবী করতে পারে যে, পৃথিবীর প্রায় ২০০ কোটি মানুষ মুসলিম। ইসলাম ধর্ম মিথ্যা হলে এতো মানুষ মুসলিম থাকতো না। খ্রীস্টানরাও একই ভাবে বলতো পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশইতো খ্রীস্টান অর্থাৎ আড়াই শত কোটিরও বেশি মানুষ এ ধর্মের অনুসারী। তাই এটাইতো সঠিক ধর্ম। লক্ষের বেশি অনুসারী থাকা যে কোন ধর্মের মানুষই এমনটা দাবি করতে পারেন। এক লক্ষ মানুষের বিশ্বাসতো কম নয়। ভুল হলে এতো মানুষতো বিশ্বাস করতো না। কিন্তু এটা একটা ফ্যালাসি বা কুযুক্তি। কতজন বিশ্বাস করলো তা দিয়ে সত্য মিথ্যাকে যাচাই করার সুযোগ নেই। যুক্তিতে প্রমাণ থাকতে হবে, কথার মারপ্যাঁচ থাকলেতো তা যুক্তি হয়ে উঠবে না। সম্প্রতি সুইডেনে কোরআন পোড়ানো নিয়ে ইরাকি বংশভূত মুসলিম সালমান/সালওয়ান মোমিকার বক্তব্য কি যুক্তিসঙ্গত? না ফ্যালাসিপূর্ণ?
তিনি বলেছেন, ‘গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও নারী অধিকারের সাথে কোরআন সাংঘর্ষিক বলেই এটি নিষিদ্ধ করা উচিৎ’। এ যুক্তিতে তিনি কোরআন শরীফ পুড়িয়ে দিয়েছেন। এটাও ফ্যালাসি। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের পেছনে যুক্তিটা মূখ্য হয়ে উঠে না। পৃথিবীতে থাকা অন্য ধর্মগ্রন্থের বিষয়েও কি একই কথা মোমিকা বলতে পারতেন না? তাহলে সুইডেনে কেন বারবারই কোরআন পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা যে রাজনৈতিক কারণেই করা হচ্ছে তা ভারতের সাথে তুলনা করলেই বুঝতে অসুবিধা হবে না। ভারতে সামন্যতেই মুসলমানদের অসম্মান করা হয়। তাতে মুসলিমরা প্রতিবাদী হয়ে উঠে এবং সংখ্যালঘুদের প্রতিবাদ করাকে সংখ্যাগরিষ্ঠরা সহ্য করতে চায় না। এসব করে ভারতে হিন্দুত্ববাদী চেতনা জাগ্রত করাই মূল উদ্দেশ্য। সুইডেনে মতপ্রকাশের সুযোগটা গ্রহণ করছে কট্টর ডানপন্থীরা। এবং মোমিকাকেও তারা ব্যবহার করেছেন তাতে সন্দেহ করার কারণ নেই। কোরআন পোড়ানোর প্রতিক্রিয়ায় মুসলিমরা ক্ষুব্ধ হয়ে বিশৃঙ্খল আচরণ করবে। সেই সুযোগটাই নিবে সুইডেনের ডানপন্থী দলগুলো। কট্টর মুসলিমরা এ বিষয়টা বুঝতে অক্ষম হবে এবং তারা পাঠাগারসহ এমন কিছু স্থাপনায় হামলা চালাবে যা সুইডেনের অগ্রসর মানুষ অপছন্দ করবে এবং সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতির পরিবর্তে ঘৃণা পোষণ করবে এবং ডানপন্থাকে সমর্থন করবে। ফলে ফ্রান্সে এক কিশোরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার পরেও মুসলিমরা বিশ্ব থেকে সহানুভূতি আদায় করতে পারেনি। কট্টর ডানপন্থীরা বারবারই মুসলিমদের ব্যবহার করছে ক্ষমতায় যাওয়ার ঘুঁটি হিসেবে। শিক্ষায় ঘাটতি থাকায় মুসলিমরাও সাধারণত যুক্তি ও কুযুক্তি ধরতে পারেন না। এমনকি তারা ফাঁদটিও বুঝতে পারেন না। মুসলিম নেতাদের মূর্খতা মুসলিমদের বারবারই পিছিয়ে দিচ্ছে। শেষ যুক্তি—
গিনির একজন পীর সমুদ্রে নামাজ পড়ছেন৷
অগাধ বিশ্বাস তাকে অলৌকিক শক্তি দিয়েছে৷
অলৌকিক শক্তি বলে কিছু একটা আছে৷
এটাও বিশ্বাস নির্ভর৷ কয়েকজন অবিশ্বাসী তরুণ জায়নামাজ তুলে দেখতে পান ভণ্ডপীর সমুদ্রের অগভীর অংশে একটি টেবিল পেতে ভক্তদের সাথে প্রতারণা করে কেরামতি দেখাচ্ছেন৷ এ থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তেও আসতে পারি যে, সব কেরামতিও প্রতারণাপূর্ণ