বিজ্ঞানী ও পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ (জন্ম ২৯ জুন ১৮৯৩, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, পৈতৃক বাড়ি- পঞ্চসার, মুন্সিগঞ্জ, মৃত্যু ২৮ জুন ১৯৭২, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ) পরিবারের কন্যা বাংলাদেশের প্রখ্যাত নজরুল সংগীত শিল্পী, স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও লেখক বুলবুল মহলানবীশ মৃত্যুবরণ করেছেন৷ গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাকে স্মরণ করছি৷ তাঁর ঠাকুরর্দা প্রকাশচন্দ্র মহলানবীশের চাচাতো ভাই ছিলেন প্রশান্ত মহলানবীশ৷। বুলবুলের পিতা অরুণচন্দ্র মহলানবীশের জন্মও পঞ্চসারে। পিতার কর্মস্থল কুমিল্লাতে বুলবুল মহলানবীশের জন্ম হয় ১৯৫২ সালের মার্চে। তবে তার ৫ মাস বয়সেই পিতার সাথে ঢাকায় চলে আসেন। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে যখন গান গাইতেন তখন তাঁর বয়স ১৯! ‘মুক্তির গানে তাঁকে আরো ছোট মনে হতো৷ তাঁকে খুবই স্বাস্থ্য সচেতনই মনে হতো৷ মেদহীন হালকা-পাতলা গড়ন বুঝতে দিতো না যে তিনি ৭০ পার করেছেন৷ অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন করায় তাঁর সাথে ঘণিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাই৷ ‘মুন্সিগঞ্জের স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তিত্ব’ বইটি লাখতে তিনি তথ্য দিয়ে সহযোগীতা করেন৷ আমার লেখালেখিতে অনুপ্রেরণা দিতেন, তথ্য দিতেন৷ ফেসবুক ইনবক্সে প্রচুর তথ্য দিতেন৷ তাঁর অনেকগুলো ছবিও বিভীন্ন সময়ে তুলেছি৷ তাঁর মৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন৷
মহলানবীশ পরিবারটির অনেক ভূমিকা রয়েছে৷ বুলবুল মহলানবীশের দাদুই বিক্রমপুরে প্রথম প্রত্নখনন করেছিলেন৷ একাধিক মাত্রার পরিমাপের উপর ভিত্তি করে কোনও বিতরণ থেকে একটি বিন্দু কতটা বিভক্ত হয় তা খুঁজে পাওয়ার জন্য ‘মহলানবীশ দূরত্ব’ হল একটি বহুল ব্যবহৃত মেট্রিক। এটি ক্লাস্টার বিশ্লেষণ ও শ্রেণি বিন্যাসের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি সর্বপ্রথম ১৯৩০ সালে জাতিগত তুলনামূলক গবেষণার প্রসঙ্গে প্রশান্ত মহলানবীশ প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি বহুপাতিক দূরত্ব পরিমাপ ব্যবহার করে জনসংখ্যার তুলনা এবং গ্রুপিংয়ের একটি উপায় খুঁজে পান। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলি বড় আকারের নমুনা সমীক্ষার সাথে সম্পর্কিত। তিনি পাইলট সমীক্ষার ধারণাটি প্রবর্তন করেছিলেন এবং নমুনা পদ্ধতিগুলির কার্যকারিতাটির পক্ষে ছিলেন। প্রথম জরিপ ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৪ সালের মধ্যে শুরু হয়েছিল এবং এতে ভোক্তা ব্যয়, চা-পান করার অভ্যাস, জনমত, ফসলের ক্ষেত্রে এবং গাছের রোগের মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। হ্যারল্ড হোটিংলিং লিখেছেন, ‘এ পর্যন্ত এলোমেলো নমুনার কোনও কৌশল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বা অন্য কোথাও তৈরি করা যায়নি, যা মহলানবীশের বর্ণিত নির্ভুলতার সাথে তুলনা করতে পারে’। রোনাল্ড ফিশার মন্তব্য করেছিলেন, ‘আইএসআই নমুনা জরিপের কৌশলগুলির মুল বিকাশে নেতৃত্ব দিয়েছে, যা প্রশাসনের কাছে উপলব্ধ সবচেয়ে কার্যকর তথ্য-প্রমাণ প্রক্রিয়া।
প্রশান্ত মহলানবীশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য থেকে স্বাধীন ভারতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অবদান রেখেছিলেন। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় তিনি শিল্পায়নের উপর জোর দিয়েছিলেন। ওয়্যাসিলি লিওন্টিফের ইনপুর-আউটপুর মডেল, মহলানবীশ মডেলের তার রূপটি দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নিযুক্ত হয়েছিল, যা ভারতের দ্রুত শিল্পায়নের দিকে নিয়ে যেতে কাজ করেছিল। তিনি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ভারতে ডিনডাস্ট্রালাইজেশন মূল্যায়ন এবং পূর্বের কয়েকটি আদমশুমার পদ্ধতি সংশোধন করতে ভূমিকা রাখেন। তিনি ১৯৫০ দশকে ভারতে প্রথম কম্পিউটার আনার প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি আগ্রহী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেক্রেটারি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছুদিন কাজ করেছেন। তিনি ভারতীয় পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউটের সেক্রেটারি ও ডিরেক্টর ছিলেন। ভারত সরকারের মন্ত্রিসভার পরিসংখ্যান উপদেষ্টা পদেও দায়িত্ব পালন করেন। গণিত ও সংগিতের প্রতিও তাঁর আগ্রহ ছিল। তিনি ভারত সরকারের পদ্মবিভূষণ খেতাব লাভ করেন ১৯৬৮ সালে। অফিসার অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার পান ১৯৪২ সালে। রয়েল সোসাইটির ফেলো হন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওয়েলডন মেডেল পান। ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়- তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ ও বুদ্ধদেব বসুর নাম বলেন।
আপনার ও আপনার পরিবারের অবদান মানুষ শ্রদ্ধার সাথেই স্মরণ করবে! গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানাই৷