সদ্যপ্রয়াত মিলান কুন্ডেরা বলতেন, ‘একজন লেখকের কাজ সত্য প্রচার নয়। একজন লেখকের কাজ হল সত্য খুঁজে বের করা।’ একজন লেখকের লেখা পড়ে পাঠক যদি উন্নত মানুষ না হয় তবে তাকে কিভাবে লেখক বলবেন? এখন বাংলাদেশের লেখকদের এমন একটা যুগ চলছে যেখানে তারা আত্মিক ও রাজনৈতিক দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী জীবন যাপন করছে। তারা শাসকগোষ্ঠীর মতোই ভোগবাদে বিশ্বাসী। আমাদের প্রধান প্রধান লেখকদের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়। তারা সকলেই পদলেহন করতে সর্বদা মাথা নত করেই থাকে। তারা সত্যকে লুকিয়ে রেখে অসত্যকে প্রচারে আনছে। যেখানে মিলান কুন্ডেরা বলতেন, কেবল সত্য প্রচার করাই লেখকের কাজ হতে পারে না। সেখানে মিথ্যা প্রচারকারীকে কিভাবে লেখক হিসেবে ধরে নিতে পারি।
আপনারা অনেকেই ফোন পেয়ে থাকেন, সরকারি বিভিন্ন সাহিত্যানুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য। অনেককে হাপিত্তেশ করতে দেখি আমন্ত্রণ না পাওয়ায়। যারা পান না বলে আফসোস করেন, তারাও পেতেন যদি ওদের কাছে আপনার নাম ঠিকানা কেউ দিতো। ওরাতো লেখক চায় না, চায় দালাল। ফলে যত কম মানের লেখক হবেন ততই আপনার কদর বাড়বে। কেউ কেউ ফোন দিয়ে লোভ দেখান, আসুন আমরা বিকল্প একাডেমি গড়ে তুলি এবং রাষ্ট্রের সুযোগ ভোগ করি। কেউ কেউ বলেন, তারা নাকি উপরের পর্যায়ে যোগাযোগ রাখেন যাতে এতো হরিলুটের মধ্যে কিছু উচ্ছিষ্ট পাওয়া যায়। এদের কাড়াকাড়ি দেখলে বাজারের লেড়ি কুত্তাদের কাড়াকাড়ির দৃশ্যই চোখে আসে। গুণদার এক ভক্ত গর্বভরে বলেছিলেন, দাদাতো এরমধ্যে একুশবার সরকারি অনুদান পেয়েছেন। সরকারি অনুদান দিয়েই এখন আমাদের কবির মান নির্ধারণ করতে হবে! অনেকেই ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চান-
১। কিভাবে নৈশভোট একটি জাতির উন্নয়নের চাবিকাঠি হয়ে উঠে। গণতন্ত্র দিয়ে কি আইসক্রীম খাবো?
২। আর কে লেখক-সাহিত্যিকদের এতোটা মূল্যায়ন করেছে?
৩। বাংলাদেশে এখন সর্বোচ্চ সংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে এবং তাতে রাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে।
৪। একজন প্রকাশক জানালেন, দেশে কেবল বঙ্গবন্ধুর উপরই সাড়ে আট হাজারের বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। এই তথ্য নাকি আবার কয়েক বছর আগের।
৫। রাষ্ট্র যাদের বই কিনে, তারাইতো বড় মানের লেখক। ফলে যাদের লেখা রাষ্ট্র কিনে তারা ফলাও করে তা ফেসবুকেও জানান দেন।
বুদ্ধির অর্থহীন অরাজকতা দেখছি। এরা মেধাকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আটকে দিয়ে হয়ে পড়েছেন শক্তিহীন। অনর্থক মাথা নত করে থাকতে থাকতে আবদ্ধ সিংহ যেন মার্জার বিড়ালে পরিণত হয়েছেন। প্রভুর পায়ের কাছে বসে বসে ম্যাঁও ম্যাঁও করছেন। একজন লেখকের সাথে আমার ভিন্নমত থাকতেই পারে যদি তিনি লেখক হন। মিখাইল বাকুনিন এর নৈরাজ্যবাদে আমি আস্থাবান নই। কিন্তু মানুষের মুক্তির জন্য তার সংগ্রামকে আমিতো অস্বীকার করতে পারি না। আমরা কলম্বাসকে দুঃসাহসী অভিযাত্রী হিসেবেই জানি। কিন্তু কোন লেখক যদি প্রশ্ন করেন, ‘রেড ইন্ডিয়ানদের জন্য কলম্বাস কি শুভ বার্তা নিয়ে গিয়েছিলেন?’ আমাদের উত্তর হাতড়াতে হয়। বাস্তবিক কলম্বাস নিয়ে গিয়েছিলেন অশুভ বার্তা! বিভিন্ন কৌশলে স্থানীয় আদিবাসীদের পরাজিত করে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। আজ আমেরিকাতে যে নিগ্রোদের দেখেন তারাও কিন্তু স্থানীয় মানুষ নন। ইউরোপীয়ানরা তাদের ধরে নিয়ে আসেন আফ্রিকা থেকে। ব্যবহার করেন দাস হিসেবে। রেড ইন্ডিয়ানরা কলম্বাসকে বিশ্বাস করে পেয়েছিল নিষ্ঠুর প্রতারণা আর মৃত্যু। মিথ্যাচার আর প্রতারণা করেই স্প্যানিস প্রতারকগণ পুরো আমেরিকাকে দখলে নিয়েছিল। ইনকা সভ্যতার মতো বহু সভ্যতাই তাদের হাতে বিলীন হয়ে যায়। এখন একজন লেখক যদি কলম্বাসকে হিটলারের পূর্বসূরি হিসেবে চিহ্নিত করেন তাহলে কি ভুল হবে? নাকি সেটাই হবে নতুন জ্ঞান? নোয়াহ হারারি এমন অনেক বিষয় সামনে এনেছেন বলেই ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে তিনি বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করতে পেরেছেন।
আমরা সমাজে ঝুঁকিমুক্ত কবিদের দেখি। তারা মাথায় তেলের ডিব্বা নিয়ে ঘুরেন। কলম বা কী-বোর্ডে আঙুল দিয়ে সেই তেলই বের করে আনেন। আমাদের সামনে একটা প্রশ্ন উঠে, ‘যে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এতো বড় ঝুঁকি নেয়ে দেশ স্বাধীনই করে ফেলল, সেই আওয়ামী লীগ কেন সুষ্ঠু ধারার গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে না?’ এ প্রশ্নের উত্তরটা আমাদের জানা দরকার। এই প্রেক্ষাপটে কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ কিন্তু লেখা হয়নি। বিস্ময়কর যে, এখনো বলা হয় ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখনো একটি মানসম্মত উপন্যাস লেখা হয়নি’। এটাই বাস্তবতা। রবীন্দ্রনাথের তো সেই অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই নেই। নজরুলেরও একই অবস্থা। আজ এখানে কাল ওখানে করে ৯ ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা দুজনই আজ আমাদের প্রধান দুজন লেখক। বাংলাদেশে দেখুন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বহু মানুষ বিনাবিচারে জেল খাটছে। কথা বলা কঠিনতম হয়ে পড়েছে। অথচ অধিকাংশ লেখক সুবিধা হারানোর ভয়ে চুপ হয়ে থাকছেন। দুএকজন লেখক যারা ইতোমধ্যে সরকারের আনুকূল্য লাভ করতে পারবেন না বলে ধারণা রয়েছে, তারাই সামান্য সরলভাবে কথা বলছেন। এ বিষয়ে ৩১টি সংগঠন শাহবাগে একবার মাত্র সমাবেশ করতে পেরেছিল সীমিতভাবে। তারপর কিন্তু আর পারেনি। কিন্তু শাহবাগের সেই সমাবেশে কয়েকজন বিশিষ্ট লেখকের আসার কথা থাকলেও তারা আসেননি। এসেছিলেন সেই আইনজীবী জেড আই খান পান্না। দুএকটি স্থানে কথা সরলভাবেই সামান্য কথা বলেন আসিফ নজরুল। এ সময়ের খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক বা কবিদের একজনকেও কেউ খুঁজে পায় না। যদি লেখকদের আনুকূল্য লাভের জন্য এতো আদিখ্যিতা থাকে তবে তারা পেশা হিসেবে দালালিকেই বেছে নিতে পারতো। অবাক হই এরা কেন লেখক হয়েছে তা দেখে। যে লেখক মানুষের মুক্তির জন্য কথা বলতে অপারগ, তাদের লেখা পড়ে মানুষ তো উন্নত মানুষ হতে শিখবে না। যে লেখক রাষ্ট্রের উচ্ছিষ্ট ভোগের জন্য দালালি করেন, তিনি তো লেখাতেও দালালিই করবেন। সেসব ছাই-ভষ্ম পড়েইবা লাভ কি পাঠকের। পাঠকতো জাঁ পল সার্ত্রের মতো লেখক চাইবে, আলবেয়ার কাম্যুর মতো লেখক চাইবে। মিলান কুন্ডেরাকে শ্রদ্ধা জানাবে। যে লেখায় থাকবে, খুঁজে বের করা নতুন সত্য। নপংশুক, নতজানু, উচ্ছিষ্টভোগী, নিকৃষ্ট অলেখকদের লেখা পড়ারতো কিছু নেই। এসব লেখকদের লেখাও আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে হবে। পারলে ওই লেখকদেরও ফেলতে হবে ভাগাড়ে। মিলান কুন্ডেরা নোবেল পাননি। কিন্তু মানুষের ভালবাসার চেয়ে বড় পুরষ্কার আর কিছু নেই। তলস্তয়, ম্যাক্সিম গোর্কি, মার্ক টোয়েন, জেমস জয়েস, এমিলি জোলা, ফ্রাঞ্জ কাফকা, গার্সিয়া লোরকা, রবার্ট ফ্রস্ট, ইবসেন, চেখভ, ভার্জিনিয়া ওলফ, এজরা পাউন্ড, আর্থার মিলার, বার্টল্ট ব্রেখট, ডিএইচ লরেন্স, লুই বোর্হেস নামগুলো দেখলে কি মনে হবে? পৃথিবীর সেরা লেখকদের তালিকা করেছি ভাববেন প্রথম দেখায়? ঠিকই ধরেছেন, বাস্তবিক এদের কেউই নোবেল পুরস্কার পাননি। তাতে তাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়নি বরং বিতর্কিত হয়েছে নোবেল কমিটিই। জাঁ পল সার্ত্রে নোবেল প্রত্যাখানের নজিরও দেখিয়েছেন। আপনি পুরস্কার পেয়েছেন না অনুদান পেয়েছেন তা দিয়ে আপনি কতবড় লেখক তা আর নির্ধারিত হয় না। আপনি সরকারের প্রতি কতটা অনুগত সেটাই প্রমাণিত হয়।