সুবিধার জন্য মানুষই বছরকে মাসে ভাগ করে নিয়েছিল। তখনও দিনের নাম আসেনি। নতুন চাঁদ উঠা থেকে মাস শুরু হয়। অর্থাৎ মানুষ মাস ব্যবহার করতে শিখেছিল আগে। এক মাস ত্রিশ দিন। দিনগুলোর কোন নাম ছিল না। সপ্তাহ ছিল না। এ অসুবিধা দূর করার জন্য প্রাচীন ব্যবিলন ও মিশরে সাত দিনের একটি সপ্তাহ ধরে কাজ শুরু করে। হিসাবটা ঠিক হলো কিন্তু নাম ছাড়া মনে রাখার বিষয়টি কষ্টকর হয়ে পড়লো। অবশেষে মিশরের ভাষা অনুসারে সূর্য, চাঁদ ও পাঁচটি গ্রহের নামানুসারে সাত দিনের নাম দেয়া হল— রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি।
আজ সারা পৃথিবীতে রবিবার, 16 July. খ্রিস্টানদের মহাপবিত্র দিন। সারা পৃথিবীর সব সভ্যতায় আজ ১৬ জুলাই নয়। যেমন বাংলা ক্যালেন্ডারে বাংলাদেশে আজ ১ শ্রাবণ। বিভিন্ন সভ্যতায় বিভিন্ন রকম মাস দিন ছিল। গত পরশু শুক্রবার ছিল মুসলিমদের মহাপবিত্র দিন৷ ইংরেজিতে ফ্রাই ডে, বাংলা শুক্রবার। ইংরেজিটা এসেছে এক দেবীর নাম থেকে বাংলাটা এসেছে গ্রহের নাম থেকে। সপ্তাহ ও মাস মানুষই করেছে। কোন অলৌকিক সত্তা কিন্তু নামগুলো ঠিক করে পাঠায়নি। যদি সপ্তাহ সাত দিনের পরিবর্তে ছয় দিনে হতো? নাম রাখা হতো ষষ্ঠাহ। ইংরেজিতে week থাকতেই পারতো। কিন্তু খৃস্টানদের মহাপবিত্র Sunday আর আজ থাকতো না। আজকের দিনটা হয়তো শনিবার থাকতো। ওই সময়ের জ্ঞানীরা ছয় দিনে ষষ্ঠাহ বানালে, প্রতি শুক্রবার আর বর্তমান শুক্রবারে আসতো না। পৌরণিক কাহিনীতেও পরিবর্তন আসতো৷ ধরলাম তারা চাঁদের নামে রাখা সোমবার বাদ রেখেছে। বাকি নাম মিলে ছয়দিন পর শুক্রবার আসে। তাহলে পবিত্র দিনগুলোর কি হতো? সময়, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, শতাব্দী ভাগ করেছে মানুষ। মানুষের ভাগ করা বা তৈরি করা দিনগুলোর একেকটিকে একেক ধর্মের স্রষ্টা পবিত্র ঘোষণা করেছেন। আবার হিন্দু ধর্মে শনিবার অপবিত্র!
জ্যোতিষীদের মতে শনির কুদৃষ্টি জীবনে অশুভ ফল নিয়ে আসে৷ এজন্য হিন্দুরা শনিবার সন্ধ্যায় শনিদেবের পূজা করে৷ শনিদেব হল সূর্যদেব ও ছায়াদেবীর পুত্র! শনিদেব একদিন ধ্যানে ছিলেন৷ তার স্ত্রী সুন্দর বেশে এসে কাম প্রার্থনা করলেন৷ কিন্তু ধ্যানমগ্ন শনি ফিরেও তাকালো না৷ স্ত্রী রাগে অভিশাপ দেয়, ‘আমার দিকে ফিরেও তাকালে না, তাহলে তোমার দিকে যে তাকাবে সে-ই ভষ্ম হবে৷ শনিদেব, দেবী দুর্গার পুত্র ভাগ্নে গণেশের দিকে তাকালে, গণেশের ধর আলাদা হয়ে যায়৷ যাক হাতির মাথা এনে বিহিত করা হয়৷ শনির দৃষ্টি আর শনিবার হয়ে আছে অশুভ৷ শুভ করার ব্যবস্থাও পুরোহিতদের জানা৷ তাতে দক্ষিণা লাগবে৷ মানুষের নাম দেয়া একটা দিন অশুভ হয়ে গেল বিশ্বাসের কবলে পড়ে৷
মুসলিমরা তাদের মহাপবিত্র শুক্রবারটাকে অন্যদের জন্য আতঙ্কের নামও বানিয়ে ফেলছে! আমার বাল্যকালে জুম্মার সময় এক হুজুর নামাজীদের জানাল, ‘মান্দ্রা গ্রামের কবিরাজ বাড়িতে এক নারীকে জোর করে হিন্দু বানানো হয়েছে৷ মেয়েটিকে উদ্ধার করতে হবে৷ আমরা একসাথে যাবো’৷ ফরজ নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমাদের মসজিদসহ বিভিন্ন মসজিদের শতশত মুছল্লী ওই বাড়ির দিকে লাঠি-চলা নিয়ে গিয়ে হামলা চালালো৷ আমি যাইনি৷ পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওই বাড়ির এক ছেলে এক মুসলিম মেয়ের সাথে প্রেম করে মুসলিম হয়ে বিয়ে করেছে৷ ওই ছেলের এক ঘণিষ্ঠ বন্ধুর বিয়ের নিমন্ত্রণে সস্ত্রীক গ্রামে এসেছে এবং বউ নিয়ে বাড়িতে এসেছে৷ মুসলমানদের পবিত্র জুম্মার দিন শুক্রবারকে মৌলবাদীরা সংখ্যালঘু হিন্দু ও প্রগতিশীল মানুষের জন্য আতঙ্কের দিন বানিয়ে ফেলেছে৷ বছর খানেক আগে প্রগতিশীল শিক্ষাবিদ ড. রতন সিদ্দিকীর বাসভবনে হামলা চালালো শুক্রবারে৷ এমন বহু হামলা ওরা জুম্মার নামাজের পরে চালাচ্ছে৷ এসব করতে গিয়ে ওরা মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে, সামান্য বিষয়কে বড় করে উপস্থাপন করছে৷ একেক ধর্ম একেকটি দিনকে পবিত্র বানিয়ে নিয়েছে। ইহুদীদের শনিবার, খৃষ্টানদের রবিবার এবং মুসলিমদের শুক্রবার পবিত্র দিন। হিন্দুদের শনিবার অপবিত্র দিন। স্রষ্টারা কি নামগুলো তৈরি করে সপ্তাহ, মাস বা বছরকে ব্যবহার করার পদ্ধতি শিখিয়েছে? দিনের নামগুলোও স্রষ্টার দেয়া নয়। শুক্র গ্রহের বাংলা নাম এসেছে অসুরদের গুরু ও রক্ষক শুক্রাচার্য থেকে, এবং শুক্রাচার্য এর দিন হিসেবে এসেছে শুক্রবার। শুক্র গ্রহের ল্যাটিন নাম ভেনাস এসেছে প্রেমের দেবী ভেনাসের নাম থেকে। এক শুক্রবারে যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল। ইংরেজিতে ফ্রাইডে নামটি এসেছে নর্স পুরাণের দেবী ফ্রেয়ার নাম থেকে। উনি ছিলেন ওডিনের স্ত্রী এবং সৌন্দর্যের প্রতীক। ভারতীয় পুরানে যেমন দেবরাজ ইন্দ্র তেমনি নর্স পুরাণে দেবরাজ ওডিন— প্রধান দেবতা।
ইহুদি ধর্ম মতেও ঈশ্বর ছয় দিনে বিশ্ব নির্মাণ করে সপ্তম দিন বিশ্রাম নিয়েছেন। এই বিশ্বাস থেকেই ইহুদি সম্প্রদায় প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত সাবাথ পালন করেন। ঈশ্বরের মানুষকে সৃষ্টি করার দিনটিকে ইহুদিরা নববর্ষ হিসেবে পালন করেন। ‘রোশ হাশানা’র দু’দিনে ঈশ্বর তাঁর বিচার সম্পূর্ণ করেন এবং মানবজাতির ভবিষ্যত নির্ধারণ করে দেন। এই উৎসবের দিনেই ইহুদিরা ঈশ্বরের কাছে কৃতকর্মের জন্য বিচার প্রার্থনা করেন এবং ঈশ্বরের ক্ষমা ও অনুগ্রহ ভিক্ষা করেন। এই উৎসবের মাধ্যমেই ইহুদি নববর্ষের সূচনা হয়।
ইসলাম ধর্ম মতে, প্রথম হিজরী সনে নবী সা. মক্কা ছেড়ে মদীনায় গেলেন। তিনি শুক্রবার সেখানে পৌঁছালেন বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায়৷ সেখানে জোহর নামাজের সময় হয়ে যায়। সেখানে তিনি ইতিহাসের প্রথম জুমার নামাজ আদায় করেন। অর্থাৎ তিনি যোহর নামাজের পরিবর্তে জুমার নামাজ আদায় করেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এর সূচনা হয় আরো পরে। মদিনার আনসার সাহাবিরা আলোচনায় বসেন। তারা উত্থাপন করলেন যে, ইহুদি ও নাসারাদের একত্রিত হওয়ার জন্য সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিন রয়েছে। আমাদের জন্য সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট দিন হওয়া প্রয়োজন, যেদিনএ আমরা সবাই সমবেত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করব এবং নামাজ আদায় করব। শনিবার ইহুদিদের আর রোববার নাসারাদের জন্য নির্ধারিত। তারা মধ্যপন্থা অবলম্বন করে শুক্রবারকে গ্রহণ করলেন এবং তারাই এ দিনকে জুমার দিন নামকরণ করলেন৷ জুমা সুরা নাজেল হয় এর পরে৷ ইসলাম মতে বিশ্বকে আল্লাহ ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। সূরা আল আরাফ-৫৪, সূরা ইউনুস-৩, সূরা হুদ-৭, সূরা আল ফুরকান-৫৯, সাজদাহ-৪, ক্বাফ-৩৮ এবং হাদিদ-৪ এ ছয় দিনে পৃথিবী সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ইসলামে সপ্তাহই থাকে ষষ্ঠাহ আসেনি৷ অনেকে বলবেন তাহলেতো সপ্তাহতো স্রষ্টাই নির্ধারণ করে দিয়েছেন সৃষ্টির শুরুতেই৷ সমস্যা হল, পৌরণিক গল্পগুলোতো এসেছে পরে৷ মানুষ দিন, মাস, বছর ভাগ করেছে আগে৷ তাহলে কার কাছ থেকে কে নিল?
শুক্রবারে মুসলিমরা, শনিবারে ইহুদিরা ও রবিবারে খ্রিস্টানরা সংঘবদ্ধ হওয়ারও সুযোগ পায়। বাংলাদেশে নিয়মিতই শুক্রবারে বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে জুম্মার পরে প্রতিবাদী মিছিল বের করা হয়। আমরা মাঝেমধ্যেঃ দেখি ফেসবুক মন্তব্য বা স্ট্যাটাসের প্রতিবাদে জুম্মার নামাজ পড়ে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে আগুন ধরায় এবং মন্দির ভাঙচুর করা হয়৷ মানুষ আরাধনা করবে স্রষ্টার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য৷ তারা অবনত থাকবে এবং মনকে পবিত্র রাখবে৷ কিন্তু আমরা দেখছি তারা আরাধনায় যাচ্ছে বুকভরা ঘৃণা নিয়ে আর সময়টা কোনরকম পার করছে হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে এবং সবাই উদ্ধত, দুর্বিনীত ও উগ্র হয়ে হামলা চালাচ্ছে৷ মূর্খ মৌলবাদীরা একবারও ভাবে না স্রষ্টা যদি মুসলিমদের সৃষ্টি করে তবে সে হিন্দুদেরও সৃষ্টি করেছে৷ তারাতো বিশ্বাস করে স্রষ্টা অসীম ক্ষমতাবান৷ তাহলে তিনি চাইলে এক সেকেণ্ডের মধ্যেই অপরাধীদের শেষ করে দিতে পারেন৷ কিন্তু মৌলবাদীদের মধ্যে স্রষ্টার ক্ষমতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে বলেই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে৷ স্রষ্টা যদি সবাইকে সৃষ্টি করে তবে তার সব সন্তানইতো সমান৷ মেথরের ঘরে যার জন্ম সেতো সাধারণত মেথরই থাকছে এবং এখন মুসলমান ঘরে জন্ম নেয়ারাই মুসলমান থাকছে৷ কারো কোন ধর্মের বা জাতির বা দলের বিরুদ্ধে আপত্তি থাকলে তা প্রকাশ করতে পারাই গণতন্ত্র৷ যদি কেউ ভুল বলে তখন সত্যটা সামনে আনাই বড় কথা৷ কে কোথায় ফেসবুকে মন্তব্য করলো আর বাজারের দশটি দোকান ভাঙচুর করলো বিপরীত পক্ষ! এটা কেমন অন্ধ বিশ্বাস? কেমন পবিত্র দিন?
যারা সৃষ্টিবাদে বিশ্বাস করে তাদের কাছে প্রথম প্রশ্ন, ‘একজন যৌনকর্মীর গর্ভে যে কন্যা শিশুটির জন্ম হল তাকে কে সৃষ্টি করেছেন? একজন মেথর বা ডোমের সন্তানদের স্রষ্টা কে? তাদের ইমান ও আমল করার হেদায়েত দেয়ার মালিক কে? আপনিতো বলবেন, ‘স্রষ্টা’! তাহলে সে কন্যা শিশুটি যদি যৌনকর্মী হয়, মেথর হয়, ডোম হয় তাহলে আপনি কেন তাদের অভিযুক্ত করবেন? আপনার চোখে ৪২৯৯ টি ধর্মই ভুল! অন্যের চোখেওতো আপনার ধর্ম ভুল৷ আপনি যদি অন্যের ধর্মকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে পারেন তবে অন্যকেও সে অধিকার দিন৷ আপনার ধর্মটি শ্রেষ্ঠ ও সত্য হলে আলোচনা ও বিতর্কের পরেই না দলে দলে লোক আপনার ধর্মে আসবে৷ কদিন আগে সুইডেনে ইদুল আযহার দিনে কোরআন পোড়ানো হল। শুনছি শিঘ্রই বাইবেল ও তাওরাতও পোড়ানো হবে। ঈশ্বরের পবিত্র গ্রন্থ, ঈশ্বরই রক্ষা করবে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন— মানুষের ভাগ করা দিনগুলো কি পবিত্র বা অপবিত্র হতে পারে? আবার একেক ধর্মে একেক দিনকে পবিত্র বা অপবিত্র বানানো হয়েছে। নবী যিশুর মৃত্যুর দিনটিকেই কেন মুসলিমদের স্রষ্টা পবিত্র দিন ঘোষণা করলেন? তাও সাহাবীরা নির্ধারণ করার পরে! আমরা না মানলেও খ্রিস্টানরাতো মানে যে তিনি ঈশ্বরের পুত্র! আমরা ঈশ্বরের পুত্র না মানলেওতো নবী মানি। সবচেয়ে বেশি মানুষের নবীকে হত্যার দিনটিকে তিনি আরেক ধর্মের মানুষের জন্য পবিত্র দিন বানালেন? বাইবেল অনুসারে ৬দিন ধরে পৃথিবী সৃষ্টি করে ঈশ্বর রবিবার বিশ্রাম নিয়েছিলেন। তাই রবিবারকে বিশ্রামের দিন ও পবিত্র দিন ধরে তারা চার্চে যায়। এজন্য খ্রিস্টাদের ছুটিও রবিবার। একই কারণে ইদীদের পবিত্র দিন শনিবার! ইতিহাসতো বলে তখনও দিন ভাগ হয়নি। মানব সভ্যতার ইতিহাসে বহু পরেই মানুষ মাস ভাগ করতে পেরেছে এরপর সপ্তাহের ভাবনা এসেছে এবং নামকরণ করেছে। অথচ আজ একেক ধর্ম একেক দিনকে পবিত্র বা অপবিত্র বলছে।