Dগত ১৬ই আগস্ট শোক দিবসের বক্তব্যকে যদি আমলে নেয়া হয় তাহলে বলতে হবে যে, এতোদিন ধরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা যেভাবে বলে আসছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের যে চাওয়া তার সঙ্গে একমত। তাহলে কি এমন ঘটলো যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বক্তব্য পুরো ইউটার্ন?? প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন “ওরা আমাকে চায় না “। আমার প্রশ্ন হলো ওরা করা? উনি কি যুক্তরাষ্ট্র ও তার বলয়ে থাকা রাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করলেন?? হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য দেশের রাজনীতিতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এদেশে মানুষের একটা সহজাত প্রবণতা হলো তিলকে তাল বানানো। এখানে গুজব তৈরী হয় প্রতি মুহুর্তে এবং তা ছোটে আলোর গতির চেয়েও দ্রুতবেগে। বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের মনে যে আন্দাজ বা পারসেপশন তৈরী হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই যুক্তি খন্ডন করা যায় না। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর কানাকানি ফিসফাস চারদিকে। আওয়ামী লীগের জন্য পরিবেশ দিন দিন বৈরী হয়ে উঠছে। গত কয়েকবছর সরকার যাদের নিয়ে জোট করছে তাদের কি কোন ভূমিকা ছিল? না ছিল না। সরকারের তৈলমর্দন করতে করতে তাদের নিজেদেরই অবস্থা তথৈবচ। জাতীয় পার্টি কিংবা অন্যান্য দল যারা আওয়ামী লীগের প্রতীকে নির্বাচিত হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে তারা সংসদের ভেতরে কার্যকর কোন ভূমিকা রাখতে পারে নি। রাজপথে তো নয়ই। ফলে গণতান্ত্রিক কাঠামো গুলো নড়বড়ে হয়ে গেছে অনেক আগেই।
আওয়ামী লীগ যত বড় দলই হোক একা তারা একটা দলমাত্র। আওয়ামী লীগ গত দুটো নির্বাচনে বিশ্বমতকে তাদের পক্ষে রাখার মধ্যদিয়ে মনে করেছে সবসময়ই সেরকমটি থাকবে। কিন্তু এতোদিন পরে এসে তাদের সে বিশ্বাস ভেঙে চুরে খান খান হয়েছে। মুল্যসফীতি বেড়ে দ্রব্য মূল্য আকাশ ছোঁয়া। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে ব্যার্থ এসরকার। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট যত বাড়ছে গত পনের বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী শ্রেণী ততই নিজেদের অর্জিত সম্পদ ও নিজেদের বাঁচাতে মরিয়া হয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিন আগে শেখ সেলিমের বক্তব্য, শোক দিবসে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্য এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে একটি সুতোয় যদি গাঁথি তাহলে কি বুঝব? প্রধানমন্ত্রী কি তাঁকে ঘিরে ভেতরে বাইরে যে কিছু একটা গন্ডগোল পাকছে তার ইঙ্গিত দিলেন? আজকে যারা ১৪ দলের শরীক তাদের অনেকেই পঁচাত্তরের ১৫ই আগষ্ট খুশীতে গদগদ হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট আমাদের কুমিল্লার এক জাসদ নেতা তাঁর রাজাপাড়ার বাড়ীতে গরু জবাই করে ভোজের আয়োজন করেছিলেন। বাড়ীতে মাইক লাগিয়ে সারাদিন গান বাজনা, হইচই আর আওয়ামী লীগ কে গালিগালাজ করেছিলেন মাইকেই। কাছেই ছিল স্থানীয় সংসদ সদস্য অলিআহম্মদের বাড়ী। মাইকটা তার বাড়ীর দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়। জাসদ তখন একটা লিফলেট প্রকাশ করেছিল। শিরোনাম ছিল – খুনি মুজিব খুন হয়েছে, অত্যাচারীর পতন অনিবার্য। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে জাসদের মূল্যায়ন ছিল এরুপ : ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ইতিমধ্যেই ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ শুরু করে দিয়েছিল। প্রতিক্রিয়াশীল আওয়ামী লীগ (পরবর্তী কালে বাকশাল) এর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধল সংশোধনবাদের বাংলাদেশস্থ এজেন্ট গণধিকৃত মণি- মুজাফফর চক্র। কিন্তু চরম ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ শেখ মুজিবকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলো না।… বুর্জোয়াদের মধ্যে দেখা দিল অস্থিরতা ও অন্তঃকোন্দল। দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের বিদেশী মুরব্বিরাও দিশাহারা হয়ে উঠল ; কোন নেতৃত্বের মাধ্যমে তাদের স্বার্থ প্রতিপত্তি কায়েম থাকবে – এ প্রশ্নে তারা দ্বিধান্বিত হয়ে উঠল। এই ডামাডোলের এক পর্যায়ে এলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। এদিন শেখ মুজিব ও তাঁর কতিপয় সহযোগী নিহত হলো। সামরিক বাহিনীর একাংশের সহযোগিতায় শেখ মুজিবেরই অন্যতম সহচর খোন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় বসল।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর অতি উল্লাসে মিছিল করেছিল বরিশাল শহরে। আ স ম ফিরোজ, আক্কাস হোসেন, শওকত, ফরিদ প্রমুখের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ওপর হামলা ও আওয়ামী লীগের অফিস ভাঙচুর করে। বঙ্গবন্ধুর ছবি এনে রাস্তায় ভাংচুর করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ছবি পদদলিত করে। প্রকাশ্যে গোসল করে খিঁচুড়ী রান্না করে খায়। ১৪ ই আগস্ট ২০২৩ তারিখে যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারদন্ডপ্রাপ্ত দেলোয়ার হোসেন সাঈদী মারা যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের স্থানীয় নেতা কর্মীরা যে হারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশ্রু বিসর্জন করেছে তাতে মনে হচ্ছে শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার পদত্যাগ কিংবা ক্ষমতা চলে গেলে এরাও গোসল করে খিঁচুড়ী খেতে দ্বিধাবোধ করবে না। এবার আসি খাওয়া খাওয়ির কথায়। ২০০১-২০০৬ বিএনপি -জামায়াত জোট সরকারের আমলে জাতীয় গ্রিডে মাত্র ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ করা সম্ভব হয়েছিল। আর গত পনের বছরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট সরকার স্থায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে যোগ করেছে কেবল ৩০০ মেগাওয়াট। কি চমকে উঠলেন? হ্যাঁ এটাই বাস্তবতা। আপনি বলতে পারেন আওয়ামী লীগ তো সভা সেমিনার কিংবা বক্তৃতা বিবৃতিতে হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলে, হ্যা বলে কারণ তা হয়েছে ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা কুইক রেন্টাল থেকে ভাড়া নেয়া। যা অত্যন্ত ব্যায়বহুল। বিএনপি জোটের সময় প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হতো ২টাকা ৫৫ পয়সা আর এখন কুইক রেন্টালে সে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিট ১০০ থেকে ১৫০০ টাকা খরচ হয়। বিএনপির সময়ে যে বিদ্যুৎ এর খুঁটি ৪৭০০ টাকায় কেনা হয়েছিল এখন আওয়ামী জোটের আমলে সে খুঁটি কিনতে খরচ হচ্ছে ৩,৪৪,০০০ টাকায়।
২০২২ সালে ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে তিন বছরে বিদ্যুৎ খাতে ৫৪ হাজার কোটি টাকার হাওয়া হয়ে যাওয়ার প্রতিবেদন করে।অর্থাৎ এ টাকা খাওয়া ভবনের ভোগে গেছে। আবার বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী গত ১২ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ গেছে ৮৬,৬৭০ কোটি টাকা। মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব বিদ্যুৎ ক্রয়ে কোনও ধরনের টেন্ডারের কোন ব্যবস্থা নেই। আরো মজার ব্যাপার হলো এই কুইক রেন্টাল কোম্পানি গুলোর সকল ধরনের কাঁচামাল ও জ্বালানি সরবরাহের দায়িত্ব সরকারের। আরো চমকপ্রদ কথা হচ্ছে কুইক রেন্টাল কে ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি দেয়া আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন উন্নয়ন খাতে ইনডেমনিটি এটাই কিন্তু প্রথম। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে মোট ৯০ টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ভাড়া দেয়া হয়েছে। প্রতিমাসে গড়ে ভাড়া দেয়া হয়েছে ১৬৮৫ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থ বছরে ১৮ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থ বছরে ১৮ হাজার ১২৩ কোটি টাকা ভাড়া দেয়া হয়েছে। তিনবছরে মোট ভাড়া দেয়া হয়েছে ৫৩,৮৮৫ কোটি টাকা। সরকার বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলিকে এই ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় ২১ হাজার ৩৯৬ মেগাওয়াট হিসাবে কিন্তু গত এপ্রিলে সবোর্চ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। আর এখন উৎপাদন হচ্ছে কম বেশি ১৩ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু ক্যাপাসিটি চার্জ সমানই আছে। এই ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয় ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল, আমদানি করা বিদ্যুৎ এবং আইপিপি ( ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) দের। ভারতের আদানি গ্রুপের সাথে ২০১৭ সালে পিডিবি বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করে। বিদ্যুৎ না পেলেও এ পর্যন্ত আদানি গ্রুপ ওই চুক্তির কারনে এপর্যন্ত বাংলাদেশের কাছে পাওনা ১২১৯ কোটি টাকা।
আওয়ামীলীগের পক্ষে যে মিথ্যাচার করা হয় তার একটা উদাহরণ দেই। পূর্ববর্তী সরকারের ২০০২-০৩ অর্থ বছরের ৬জুন প্রস্তাব কৃত বাজেটের আকার ছিল ৪৪,৮৫৪ কোটি টাকা। ২০০৩-০৪ অর্থ বছরে ৫১,৯৮০ কোটি টাকা। ২০০৪-০৫ অর্থ বছরে মোট বাজেট ছিল ৫৭,২৪৮ কোটি টাকা। ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে ৬১,০৫৮ কোটি টাকা। ২০০৬-০৭ অর্থ বছরে ৬৯,৭৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছরে মোট বাজেটের আকার ছিল ২লাখ ৮৪ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৯জুন প্রস্তাব কৃত বাজেটের আকার ছিল ৬,৭৮,০৬৪ কোটি টাকা অর্থাৎ জোট সরকারের ৫ বছরের যে বাজেট আওয়ামী লীগের ১ বছরের বাজেট তার তিনগুণ। ২০০১-০৬ সালে এদেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণ ছিল ৬০০০ টাকা আর এখন মাথাপিছু ঋণ ৯৭,৭৪০ টাকা। বিএনপির আমলে সবচেয়ে অবহেলিত বিদ্যুৎ খাতে পাঁচ বছরে বাজেটে বরাদ্দ ছিল সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। অপর পক্ষে শুধু মাত্র ২০২২ সালেই বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা ২০২১ সালে যা আরো ১ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ ধরা হয়েছিল। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মহলে বিএনপির আমলে যে ২০ হাজার কোটি টাকা বিদ্যুৎ খাত থেকে লুটপাটের কথা বলা হয় তা আসলে একটা কল্পকাহিনি। আচ্ছা ধরেই নিলাম যে বিএনপি, হাওয়া ভবন ৫ বছরে বরাদ্দ কৃত সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার পুরোটাই লুট করেছে তাহলে গত ১৫ বছরে এবং ১/১১ সরকার বিদ্যুৎ খাতে লুটপাট করা বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে কেন মামলা হয়নি? এ কথা গুলো কেন বলছি জানেন আওয়ামী লীগ সবসময়ই পূর্বের সরকার এই করেছে ওই করেছে কেন বলে জানেন? নিজেদের গত ১৫ বছরের লুটপাট কে আড়াল করার জন্য তারা ১৭ বছর আগের সরকারের লুটপাটের গল্প শোনায়। সরকার মনে করে এদেশের মানুষের ভুলে যাওয়ার রোগ আছে, আমরা মিথ্যাচার করলেও ডিমেনশিয়ায় ভোগা এদেশের মানুষ ১৭ বছর আগের ঘটনা শুনবে। এতো কেবল একটা খাতের খাওয়া খাওয়ির গল্প। বাকী কত কত খাত যে জনগনের অজানা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দক্ষিন আফ্রিকা থেকে ফিরে এসে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন জনগন অংশগ্রহণ করলেই নির্বাচন অংশগ্রহণ মূলক হবে তাঁর এই বক্তব্য শুনে আমি বিস্মিত হয়েছি। অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচনে কি কেবল জনগন অংশগ্রহণ করলেই হয়? রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ লাগে না? আচ্ছা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কথায় কথায় ভোট চোর, ভোট ডাকাত কাকে বলেন? ধরে নিলাম মাগুরার একটি সংসদীয় আসনে ভোট চুরির জন্য যদি উনি বিএনপিকে ভোট চোর ভোট ডাকাত বলেন তাহলে গত ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ৬৬০ টি সংসদীয় আসনে যা হয়েছে সেটা কে কি বলা যায়?
১৭ বছর আগের হাওয়া ভবন আজ খাওয়া ভবনে রুপান্তরিত হয়েছে। দেশের মানুষ সে খাওয়া ভবনের লুটপাট দুর্নীতি অবাক বিস্ময়ে দেখছে। বিএনপি সরকারও হাওয়া ভবন যদি শুটকির বস্তার বিড়াল পাহারাদার হয়ে থাকে তাহলে আজকের আওয়ামী লীগ ও খাওয়া ভবন শুটকীর নৌকায় বিড়াল পাহারাদার।