আব্বাসীয় সাম্রাজ্যে ভাঙন, মঙ্গোল আক্রমণ, স্পেনসহ বিভিন্ন স্থান থেকে মুসলিমদের পিছু হটা কিংবা মুসলিমদের মধ্যে দর্শন-বিজ্ঞান বিরোধী মনোভাব তৈরি হওয়া ইত্যাদি যে কারণেই হোক ইসলামি স্বর্ণযুগের বিলুপ্তি হয়েছে কমবেশি ৮শ বছর। এরপরে মুসলিমরা বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্য ইত্যাদি কোন জ্ঞানেই আর এগিয়ে যেতে পারেনি। এরমধ্যে আসা সালাফি মতাদর্শ তাদের আরো পিছিয়ে দেয়। একটা কট্টরপন্থার চেয়ে তারা ঢুকে পরে আরেকটি কট্টর পন্থার দিকে। তারা ধর্মশিক্ষায় আচ্ছন্ন থেকেছে। তারা আল আজহার, আলীগড় কিংবা দেওবন্দ মাদ্রাসা নিয়ে যতই গর্ববোধ করুক কিন্তু ওখানে যে শিক্ষা দেয়া হয় তা তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথ আরো রুদ্ধই করে দেয়। তারা জ্ঞানের অন্বেষণের চেয়ে ঐশি শক্তির কাছে প্রার্থনা করাকেই সমস্যা সমাধানের পথ হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু কোন ঐশি শক্তিই মুসলিমদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি।
সবাই জানতো যে, হামাসের আক্রমণে শেষ পর্যন্ত মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে গাজার সাধারণ মানুষ। ইতোমধ্যে মৃতের সংখ্যা চার হাজার অতিক্রম করেছে। আমার এলাকাতেও দেখলাম প্রতিবাদ সমাবেশ ও রাস্তায় দোয়ার আয়োজন। অনেকেই ইসরাইলি ও ইহুদিদের পণ্য বয়কটের ডাক দিচ্ছেন। এই বর্জনের সীমা এতোটাই প্রকট হবে যে, তা কারো পক্ষেই আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। যারা ডাক দিচ্ছেন দেখা যাবে যে, তারাই নিমজ্জিত রয়েছেন, ইহুদিদের আবিষ্কার করা পণ্যে। ফেসবুকেই বেশি সরব হচ্ছেন অনেকে কিন্তু যে ফেসবুকে বয়কটের ডাক দিচ্ছেন তাও একজন ইহুদির করা। চিকিৎসা বিজ্ঞান, ইলেক্ট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক আবিষ্কার, ইন্টারনেট টেকনোলজি, পদার্থ, রসায়ন ইত্যাদি বহু ক্ষেত্রেই তাদের আবিষ্কারকে মেনে নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আবাবিল পাখির মিথ ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে পারবে না। বাস্তবিক ইসরায়েলকে ধ্বংস করারও দরকার নেই। যদি জ্ঞান বিজ্ঞানে মুসলিমরাও এগিয়ে যেতে পারে তবে মুসলিমদের কোন সমস্যাই থাকবে না। আজ মুসলিমদের প্রধান সমস্যাই অশিক্ষা ও কুশিক্ষা। এই অশিক্ষা ও কুশিক্ষাই মুসলিমদের আটকে রেখেছে ৮শ বছর আগের অবস্থানে।
মুসলিম স্বর্ণযুগের জ্ঞানীরা নির্ভর করেছিল গ্রীক বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের উপর। তারা ফার্সি/আরবিতে অনুবাদ করে নিয়েছিল গ্রীক জ্ঞান। আর তার উপর ভর করেই এগিয়েছিল বাগদাদের দার্শনিক-বিজ্ঞানী-সাহিত্যিকরা। আজ বলা হয়, বাগদাদের সেই জ্ঞানই ইউরোপে এনে দিয়েছিল রেনেসাঁ। ইউরোপ মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্রসেড করেছিল। তারা পারস্যের জ্ঞানকে অস্বীকার করেনি। যত্ন করে সাথে করে নিয়ে অনুবাদ করেছে। সেই জ্ঞানকেই ভিত্তি করে এগিয়েছে। আর মুসলিমরা হায় হায় করেছে। এই হায় হায় করাটা আমরা ভারতেও দেখেছি। যখন ইংরেজরা আসলো তখন ইংরেজদের জ্ঞান হিন্দুরা গ্রহণ করলেও মুসলিমরা করেনি। তারা শুরুতে ইংরেজদের তাড়াতে সচেষ্ট থেকেছে। পরবর্তীতে আমরা দেখি ভারত থেকে ইংরেজ তাড়াতে তারা অনিহাই দেখিয়েছে। বলা হয় ইংরেজরা আরব/তুরষ্ককে হাত করেই ভারতের মুসলিমদের নিকট ইংরেজদের পক্ষে থাকার বার্তা এনেছে। ইংরেজদের পক্ষে শেষ দিকে থাকলেও তাদের জ্ঞান গ্রহণে অনিহাই প্রদর্শন করেছে।
আমি একটি মাদ্রাসা কিছুদিন শিক্ষকতা করেছি। সেখানে লেখাপড়া বলে কিছু ছিল না। হুজুর শিক্ষকরা ব্যস্ত থাকতে ওয়াজের জন্য গলায় সান দিতে। আমাকে নিতে হতো একসাথে তিন/চারটি ক্লাস। সেভেনে পড়া দিয়ে ছুটতাম একাদশে, সেখানে পড়া দিয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। গণিত খাতা দেখার দায়িত্ব পড়ল। ক্লাস সেভেনে সবাই ফেল করেছে। খাতা দেয়ার আগে এক ছাত্র দাঁড়িয়ে বলল, স্যার গতবার হুজুরে ৯৯ দিয়েছে এবার কিন্তু ১০০ দিতে হবে! ওরা কেন অংকে ভুল করে তা আগে বুঝিয়ে বললাম। এরপর খাতা দিলে ওরা মেনে নিল এবং জানাল কেউ তাদের এমনভাবে বলেনি। আমি অন্যদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেন এভাবে নাম্বার দেয়া হয়। তারা বলেছিলেন, ‘দিয়া থন, পোলাপান খুশি থাকবো’। এভাবে খুশি থাকা পোলাপানেরতো জ্ঞানের বিকাশই হয় না। ফলে তারা লুতুকওমে ব্যস্ত থাকে সময় কাটাতেও। এভাবে জ্ঞানবিমুখ থাকলে আরো ৮শ বছরেও মুসলিমদের কোন উন্নতি হবে না।
হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ- কারো সাথেই বৈরিতা করার যুগ এটা নয়। এখন যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাবে কদর হবে তাদেরই। উনবিংশ শতক পর্যন্ত ইহুদিরা ইউরোপে এবং বিশ্বজুড়েই নিপীড়িত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও বিপুল সংখ্যক ইহুদিকে হত্যা করা হয়। তারা এখন সংখ্যায় কমবেশি মাত্র দেড় কোটি। অনেকেই হাহাকার করে কেন পাশ্চাত্য গুটি কয়েক ইহুদিকে সমর্থন দিচ্ছে সবসময়? কেন ইসরায়েলের আগ্রাসনকে মেনে নেয়? পাশ্চাত্য জানে গুটি কয়েক ইহুদি শিক্ষা ও বিজ্ঞানে কি দারুণ ভূমিকা রেখে চলছে। তাদের জ্ঞানের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে পাশ্চাত্যকেই। আর মুসলিমদের জ্ঞান হল ঐশি শক্তির উপর নির্ভরশীরতা। অন্যদের ফাঁসাতে তারা অনবরত দোয়া-দরুদ পড়তে থাকে। শেষে তা কোন কাজে না আসলে নামে প্রতারণায়। আমরা বাংলাদেশে দেখি একজন মুসলিম মৌলবাদীই কোরআনে পায়খানা করে হিন্দুদের ফাঁসাতে চায়, মন্দিরে প্রতিমার হাতে কোরআন রেখে ঝামেলা করতে চায়। ফলে তাদের কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। যখনই শুনেছি হনুমানের হাতে কোরআন তখনই সন্দেহ করেছি কোন মুসলিম মৌলবাদী ধর্মান্ধ উন্মাদের কাজ এটা। আমিসহ অনেকেই এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। বাস্তবে হয়েছেও তাই।
ইহুদি-নাসারাদের ধ্বংস চেয়ে কি পৃথিবীর কোন লাভ আছে। ক্ষতি রয়েছে মারাত্মক। মুসলিমরা একবারও প্রার্থনা করে বলে না যে, ‘হে আল্লাহ, আমাদের তুমি ইহুদি-নাসারাদের মতো জ্ঞানী বানিয়ে দাও। তারা অন্তত বলতে পারে, হে আল্লাহ আমাদের জ্ঞান দাও যাতে আমরা উন্নতি করতে পারি। তারা কেবল, ইহুদি নাসারাদের পতন চায়। গতকালও দেখলাম সেই বার্তাই। গত ৮শ বছরে আল্লাহ একবারও মুসলিমদের আহবানে সাড়া দেননি। এভাবে চললে আগামী ৮ লক্ষ বছরেও আল্লাহ সাড়া দিবেন না। এখন মুসলিমদের এগিয়ে যেতে হলে, ইহুদি-নাসারাদের জ্ঞানকেই ভিত্তি ধরে এগিয়ে যেতে হবে। গ্রহণ করতে হবে, তাদের গণতন্ত্র ও মানবতাবোধ। এরপর তাদের জ্ঞান গ্রহণ করতে হবে। এখন পৃথিবীতে এমন একটি মুসলিম প্রধান দেশও নেই যেখানে গণতন্ত্র আছে। মুসলিমরা গণতন্ত্র বুঝে না তারা বুঝে পীর বা স্বৈরশাসকের পেছনে দৌড়াতে হবে। তারা বুঝে নিজেদের ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে দিতে হবে অন্যদের উপর। প্রথমে চাপায় পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্রের উপর, তারপর বিরোধী মতের উপর, এরপর প্রতিবেশি গোষ্ঠীর উপর, এরপর ভাইর উপর এবং শেষ নিজের স্ত্রী-শাশুড়ির উপর। এ ধারায় অভিশাপও চলতে থাকে। এটাই আমাদের শিক্ষা।
ধর্মভিত্তিক শিক্ষা, দলকানা শিক্ষা, বিজ্ঞানবিরোধী শিক্ষা মুসলিমদের এগিয়ে দেয়নি। কোনদিন দিবেও না। ওয়াজে দাবী করা হয়, যদি মুসলিমরা সবাই সহিভাবে ধর্মে আচ্ছন্ন থাকে তবেও তারা এগিয়ে যাবে। ফলে ধর্মশিক্ষা বাম্পার হচ্ছে এবং যথারীতি এমন শিক্ষায় মুসলিমরা তলিয়ে যাচ্ছে। কেবল ধর্মীয় অন্ধত্বের কারণেই মুসলিমরা ৮শ বছর ধরে বিজ্ঞানবিমুখ রয়েছে। প্রতিকারও তাদের হাতে। তারা তা গ্রহণ করবে কিনা তাদেরই ভেবে দেখতে হবে।