প্যারিস প্রবাসী সিরীয় কবি আদোনিস বলেছেন, “মুসলিম বিশ্বকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকলে চলবে না। এখনো তারা শুধু ব্যবহৃত হচ্ছে। চিন্তা ও সৃষ্টিশীলতায় বাকি বিশ্বের সঙ্গে বোঝাপড়া না করলে তাদের মুক্তি নেই।” মুসলিম বিশ্ব দৃঢ়ভাবেই প্রতিজ্ঞ যে তারা পাশ্চাত্যের প্রযুক্তিগত সুবিধা ভোগ করবে কিন্তু পাশ্চাত্যের আদর্শ ধারণ করবে না। পাশ্চাত্য বিরোধী বয়ান কয়েক দশক ধরে তীব্রভাবেই আছে। আমাদের সিনিয়র এক বন্ধু একবার হুমায়ুন আজাদ স্যারের সাথে বিতর্কে বারবারই পাশ্চাত্যের আনবিক বোমার প্রসঙ্গ আনায় স্যার বলেছিলেন, তোমার মাথায় কি একটা পড়েছে? বিজ্ঞানের কিছু নেতিবাচক আবিষ্কারতো আছেই তবুও বলতে পারি এতো এতো আনবিক-পারমানবিক বোমা থাকার পরেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তার ব্যবহার হয়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র দুটি বোমার ব্যবহার হয়েছে। এই একটা উদাহরণ দিয়ে বিজ্ঞানের উন্নয়নের হাজার হাজার দিককে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশসহ মুসলিম দেশগুলোতে সম্প্রতি পাশ্চাত্য বিরোধীতা প্রকট হয়ে উঠেছে।
এডওয়ার্ড সাঈদের লেখা পড়ে প্রাচ্যবাদ সম্পর্কে পাশ্চাত্যের বয়ানে হঠাৎই সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। প্রাচ্যের অতীত ও সভ্যতাগুলো অনেক উজ্জ্বল হয়ে দেখা দিয়েছিল। গ্রীকসহ ইউরোপ সভ্য হয়েছে এই সেদিন। আর আমাদের রয়েছে মিশরীয় সভ্যতা, ব্যাবলিনীয় সভ্যতা, হরপ্পা-মহেনদোজারো সভ্যতা, সুমের সভ্যতা ও মেসোপটেমিয়ান সভ্যতা। অটোম্যান, মোগল ও ইরানের মুসলিম সাম্রাজ্য একত্রে মধ্যযুগে অর্ধেক পৃথিবী শাসন করেছে। এছাড়া আধুনিক ইউরোপ গড়ে উঠেছে ইসলামি স্বর্ণযুগের জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে। গর্বে আমাদের বুকটা ভরে উঠতে পারে এবং আমরা পাশ্চাত্যকে প্রত্যাখ্যান করতে পারি। কিন্তু তুলনাটা যখন আজকের বিশ্বেই করতে হয় তখনই ফাঁকটা বেরিয়ে আসে। ঢাকার খাজা পরিবারের যখন রমরমা অবস্থা তখন বঙ্গবন্ধুর পরিবারে ছিল দারিদ্র্যতা। আজ যদি খাজা পরিবার বৃটিশ ভারতে বা পাকিস্তানি আমলে থাকা তাদের প্রভাব নিয়ে বিভোর থেকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে উড়িয়ে দিতে চায় তবে সেটা নিতান্তই হাস্যকর হয়ে উঠবে। তুলনাটা করতে হবে আজকের হিসেবেই।
পাশ্চাত্যের সাথে আমদের মোটা দাগে পার্থক্য হল সংস্কৃতি, শিক্ষা ও অর্থনীতিতে। তবুও মধ্যপ্রাচ্যে তেল আছে এবং চীন, জাপান, সিংগাপুরের অর্থও রয়েছে। যদিও জাপান ও সিংগাপুরের সংস্কৃতিকে আমরা পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিই বলছি। সংস্কৃতি ও শিক্ষার ক্ষেত্রে বাকি প্রাচ্যের কি অবস্থা। নারীদের কথাই ধরি। এশিয়াতে ১৩৫ কোটি মুসলমান বাস করে। মুসলিম নারীদের সাথে পাশ্চাত্যের নারীদের একটা তুলনা করতে পারি। মুসলিম নারীরা সাধারণত বোরকা/হিজাব পরিধান করে। তারা নিজেরা সাধারণত উপার্জন করে না এবং মুসলিম বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেনি। বিপরীতে পাশ্চাত্যের নারীরা নিজেরা স্বাবলম্বী এবং মানুষ হিসেবে তারা পুরুষের সাথে সমান তালেই এগিয়েছেন। তারা পুরুষের মতোই সাধারণ পোষাকে কাজ করছে। পাশ্চাত্যে নারী নিপীড়নের হারও অনেক কম। গৃহে বাংলাদেশের নারীরা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হন। আবার তারাই আনুপাতিক হারে খুব কমই আইনের আশ্রয় নেন। আমাদের সংস্কৃতিতে এটাকেই বলা হয় নারীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। অর্থাৎ নারীর প্রতি যত নিপীড়নই করা হোক, নারী হবে সর্বাংসহা এবং এটাই যেন নারীর মহত্ব। এমন ভাবাদর্শকে আমরা যতই উঁচু করতে চাই সভ্য দুনিয়া তা মানবে না। ওভার অল আমাদের চেতনা হল পরকাল নির্ভর আর পাশ্চাত্য ভাবে পৃথিবীতেই তাদের উন্নয়নের কথা। আমরা যখন ভোটের অধিকারের কথা ভাবতেই পারি না তখন পাশ্চাত্য নিজেরা নিজেদের নেতা নির্বাচন করছে এবং নেতার কাছ থেকে জবাবদিহিতা আদায় করছে। তাদের পুলিশ নাগরিকদের কল্যাণে ভূমিকা রাখছে। নাগরিকদের রক্ষায় সচেষ্ট থাকছে। আর আমাদের পুলিশ আমাদের রাখছে ধমকের উপরে। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে আমরা জিম্মি। এমন হাজারটা উদাহরণ আমরা দিতে পারি।
কয়েক বছর ধরে প্রাচ্যবাদ নিয়ে খুব বেশি চর্চা হচ্ছে। সেটা করছি এডওয়ার্ড সাঈদের দৃষ্টিকে বিকৃত করে। এবং এই চর্চা করতে গিয়ে আমরা পাশ্চাত্যের সর্বাত্মক বিরোধীতাই করছি। পাশ্চাত্য চায় গণতান্ত্রিক বিশ্ব আর প্রাচ্যের শাসকগণ হতে চায় স্বৈরতান্ত্রিক। তারা নিজেদের মতো বয়ান তৈরি করে তা পাঠ্যভূক্ত করে। তারা নিজেদের মতো ইতিহাস লিখে আমাদের গিলাতে চায়। তারা অনবরত পাশ্চাত্যের বিরোধীতা করে আমাদের দিয়ে পাশ্চাত্যকে ঘৃণা করাতে চায়। আমাদের গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে নিতে চায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় অধ্যাপকও পাশ্চাত্য বিরোধী বয়ান তৈরি করছে। আমাদের মিডিয়া ও শিক্ষার্থীরা সে বয়ান প্রচার করছে। যারা সকালে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে গালিগালাজ করছেন তারা বিকেলেই প্লেনে উঠছেন পাশ্চাত্যে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তারা সাধারণ মানুষকে পাশ্চাত্য বিরোধী মানুষ বানাতে চান। যাতে মানুষ তাদের মানবাধিকারের কথা ভুলে যায়, ভোটাধিকারের কথা ভুল যায়। সরকারের বিরুদ্ধে যে কথা বলতে হয়, মানুষ যেন সেই ভাবনা ভাবতেও ভয় পায়। জবাবদিহিতা শব্দটিও যেন মানুষ উচ্চারণ করতে না পারে। পাশ্চাত্য বিরোধী বয়ান তৈরির হিসাবটা আমরা ধরতে পারি না।
লিবিয়া ও ইরাক পাশ্চাত্যের বিরোধীতা করেছিল ক্ষেপণাস্ত্র মেরে৷ কেবল গাদ্দাফি আর সাদ্দামই পরিণতি ভোগ করেনি৷ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে দেশ দুটির সকল নাগরিকই৷ মায়ানমারের পরিণতি কী হল তাও দেখলাম৷ পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে গিয়ে ইমরান খানও টিকতে পারেনি৷ ইউক্রেন ধ্বংস হয়ে গেলে পাশ্চাত্যের কিছুই যায় আসে না৷ যুদ্ধক্ষেত্র হওয়ার পরিণতি কেবল জেলেনেস্কিই ভোগ করবে না৷ পাশ্চাত্যের লক্ষ্য রাশিয়া৷ এই যুদ্ধের যে খেসারত রাশিয়া দিচ্ছে তা কাটিয়ে ওঠাও তাদের জন্য সহজ হবে না৷ রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির জন্য ইউক্রেনকে বিসর্জন দেয়া পাশ্চাত্যের জন্য ব্যাপারই না৷ পাশ্চাত্যের যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হন অথবা আগ্রাসনের শিকার হন পরিণতিটা ভয়ানকই৷ শেষ পর্যন্ত ক্ষতিটা হয় নাগরিকদেরই৷
বিপরীতে পাশ্চত্যের সুষ্ঠু গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে গ্রহণ করে যদি বৈষম্যহীন কাঠামো গঠন করা যায় তবেই না মানবিক রাষ্ট্র গঠন করা যাবে৷ প্রাচ্যবাদীদের মিশনটা কেবলই একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের জন্যই৷ তারা কোন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে নামেনি৷ প্রভুদের তুষ্ট করতেই একটু ঘেউ ঘেউ করছে৷