বাংলাদেশে পীরের সংখ্যা কতো? আমি দক্ষিণের একটি বড় শহরের একটি সড়কে গিয়ে তাজ্জব বনে গেলাম— সড়কের দুই ধার ধরেই বহু পীরের নামের সাইনবোর্ড। দেশে পীরের সংখ্যা ২ লক্ষ ৯৮ হাজার! অনেকে বলেন, এরা হাক্কানি পীর নয়। হাক্কানি পীর আছে অল্প কয়েক জন! হাক্কানি কারা? কে তাদের নির্ণয় করবেন? বাস্তবিক মুরিদদের কাছে একমাত্র তার পীরই হাক্কানি। পীরগণ দাবি করেন তারা এমন ওলি-আল্লাহ যারা কোন তরিকার প্রতিষ্ঠাতা বা খলিফা। পীরদের আমরা সাধারণত দক্ষিণ এশিয়া ও ইরান-ইরাকেই দেখি। পীর শব্দটি ফারসি— এর ঠিক আরবি শব্দও নেই। অনেকে শায়খ/শায়েখ শব্দকে পীর বলে চালাতে চান। তবে শব্দ দুটির আলাদা অর্থই বহন করে। পীর শব্দের অর্থ বৃদ্ধলোক! পীরগণ দাবি করেন এর অর্থ জ্ঞানি৷ হয়তো দুটোই সমার্থক৷ একদা বৃদ্ধরাই জ্ঞানি হতে পারতো৷ পীরগণ সবসময় দাবি করেন, তারা মুরিদদের শাফায়ত করবেন। তাদের বক্তব্য শুনলে মনে হবে যেন তারা শাফায়াত করার দায়িত্ব পেয়েছেন। পীর না ধরে যেনো মুক্তি মিলবে না। অথচ কোরআন-হাদিসে পীর ধরার কথা বলা হয়নি। পীর ধরা ফরজ নয়, সুন্নত নয়, নফলও নয়। তবে পীরদের মুরিদ ধরা ব্যবসায়ীদের কাস্টমার ধরার মতোই লাভবান বিষয়। আছে কাস্টমার ভাগিয়ে নেয়ার প্রকট দ্বন্দ্বও!
চরমোনাই পীরের একটি বইতে দেখেছিলাম— হাশরের ময়দানে তার মুরিদদের জন্য জাহাজ আসবে। সেই জাহাজে করে মুরিদরা পুলসিরাত পার হয়ে যাবেন। অনেক পীরই দাবি করেন, তার মুরিদ হলে— আখেরাতে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে। তিনিই যেহেতু আল্লাহর ওলি তাই তিনিই মহানবী সা. এর শাফায়ত পেতে সহায়তা করতে পারবেন। অনেক পীর মুরিদদের ধোঁকা দিতে একটি হাদিসের কথা বলেন, ‘যার পীর নাই, তার পীর শয়তান।’ আবার অনেকে এগুলোকে জাল হাদিসই বলেন। তাহলে এমনটা কেন বলেন? ব্যবসার জন্যই বলেন। বিস্মিত হই যখন দেখি পীরদের অধিকাংশরই জন্ম ৬টি জেলায়- ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী ও চট্টগ্রাম। এর অধিকাংশই আবার চরাঞ্চলে। কেন এতো পীরের জন্ম চরাঞ্চলে?
পীরদের অন্ধ-অনুসারী দরকার হয় দুটি কারণে। প্রথমত যা বলবে তাই প্রশ্নহীন বিশ্বাস করে প্রচারণা চালানোর জন্য আর দ্বিতীয়ত বিপুল সংখ্যক অসচেতন দরিদ্র মানুষ নিয়ে দল ভারি করা। আমি একজন পীরের উত্থান দেখলাম সিরাজদিখানের চন্দনধুল গ্রামে। তাঁর মুরিদরা কয়েকটি অলৌকিক ঘটনার কথা প্রচার করলেন তার একটি এমন:
“এক মহিলা গলায় ঘ্যাগ (গলগণ্ড) নিয়ে পীর ছাহেবের কাছে আসলেন। পীর ছাহেব গলায় ফু দিয়ে পুকুরে ডুব দিতে বললেন। মহিলা পুকুরে ডুব দিয়ে উঠে দেখে ঘ্যাগ নাই সাথে গলার স্বর্ণের চেইনও নাই। মহিলা বলল, ‘হুজুর চেইন ছাড়া বাড়ি গেলে আমার স্বামী মেরে ফেলবে’। পীর ছাহেব বললেন, ‘ঘরে রাখা কলসে হাত দিলেই পেয়ে যাবে’। মহিলা বিশ্বাস করল না। সে চেইন ফেরত চাইল। পীর ছাহেব মহিলাকে আবারো পুকুরে ডুব দিতে বললেন। ডুব দিয়ে উঠে দেখলো মহিলার গলায় স্বর্ণের চেইন ফিরে এসেছে, সাথে ঘ্যাগও।”
এমন কয়েকটি ঘটনা বিপুলভাবেই ছড়িয়ে দেয়া হল। প্রতিদিন ২০/৩০ হাজার মুরীদ দোয়ার জন্য যেতো মোমবাতি ও আগিরবাতি নিয়ে। ২০/৩০ হাজার মোমবাতি+ আগরবাতি (প্রতিজনের গড়ে ৭০/- টাকা) আবার চলে যেতো দোকানে। বছরে আয় কতো? ২০,০০০ জন × ৭০ টাকা ×৩৬৫ দিন= ৫১ কোটি ১০ লক্ষ টাকা। এক বছরের আয় দিয়েই তিনি বনানীতে বাড়ি কিনেন। অথচ আগে চালাতেন ছোট একটি চাউলের দোকান। কষ্টেসৃষ্টে সংসার চলতো। গলগণ্ড রোগ হয় আয়োডিনের অভাবে। অলৌকিকভাবে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন কারণই নেই। মানুষ প্রশ্ন তুলে না পীরের ভুয়া কেরামতির জন্য। পীরেরা প্রয়োজনে টাকা দিয়ে নাটক সাজায়। অল্প টাকায় তথাকথিত সাগরেদদের দিয়ে মিথ্যা অলৌকিকতার প্রচার চালায়। অন্ধ বিশ্বাস রাখা ও প্রচার চালাতে এমন লোক পাওয়া সহজ হয় চরাঞ্চলে। চরাঞ্চলের মানুষ সাধারণত শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থাকে, তাদের জীবন হয় কষ্টসাধ্য, তারা সচেতনতা অর্জন করে না। কাছাকাছি যখন একজন কথিত অলৌকিক ক্ষমতাধর মানুষকে পেয়ে যায় তখন শতভাগ বিশ্বাস করে প্রশ্নহীনভাবে। নদী ও প্রকৃতির হাত থেকে বাঁচতেও তাদের অলৌকিক শক্তির উপর নির্ভর করেন। পীরের নির্দেশে সাগরেদরা অলৌকিকতার গল্প হাটে বাজারে ছড়িয়ে দেয়। তখন শুধু স্থানীয় মানুষই নয়, দূরদূরান্ত থেকে দুর্দশাগ্রস্থ মানুষ নিষ্কৃতি পাওয়ার আশায় তাদের কাছে আসে। সাজানো অনেক অলৌকিক ঘটনা দেখে তারা বিশ্বাস স্থাপন করে। পীর ছাহেব তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা প্রমাণ করতে প্রায়শই মুরীদদের মধ্যে উপকার পেয়েছে এমন মানুষদের ডাক দেয়। তার সাজানো লোকেরাই উঠে দাঁড়ায় এবং বলে, তাকে ঢাকার ক্যান্সার হাসপাতাল থেকে ফেরত দিয়ে বলেছিল, আর ৩ মাস বাঁচবেন। হুজুরের দোয়ায় আজ ৩ বছর তিনি সুস্থ আছেন এবং রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। একজন মানুষের মধ্যেও প্রশ্ন জাগে না— এটা কি সাজানো? ওই ভুয়া রোগীকে কি টাকা দিয়ে অভিনয় করাচ্ছে? কেন আসে না এমন জিজ্ঞাসা?
বরিশাল, ফরিদপুর, মাদারিপুর, শরিয়তপুর, পটুয়াখালি জেলাগুলো অধিক নদীমাতৃক৷ নদীর গতিপথও বহুবার বদলেছে৷ বদলে যায় অবস্থান৷ মানুষ ভেসে বেড়ায় এক চর থেকে আরেক চরে৷ স্থায়ী জীবন না হলে সুশিক্ষা গ্রহণের সুযোগও তৈরি হয় না৷ গড়ে উঠে না— ভাল সংস্কৃতি৷ এদের মধ্যেই চালাক চতুরগণ আদি কালে নিয়ে আসতো নতুন নতুন ধর্ম৷ কিন্তু একালে মুসলিম প্রধান দেশে নতুন ধর্ম আসা অসম্ভব৷ কারণ তাদের রয়েছে শেষ নবী, শেষ ধর্ম৷ ফলে চরের চালাক-চতুর লোকেরা হয়ে উঠে পীর! দেখায় অলৌকিক ক্ষমতা৷ বোকা চরের মানুষ অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে পীরদের ভুয়া অলৌকিক ক্ষমতার কথা ছড়িয়ে দেয়৷ মানুষ তাদের জীবনের সংকট ও কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে যেতে থাকে এক চর থেকে আরেক চরে৷ তারা আশার বাণি শুনতে থাকে৷ সময় মানুষকে সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটায়৷ আর সেই ক্রেডিটও যায় পীরের হাতে৷ তাই চর ছাড়া বা চরের কাছাকাছি এলাকা ছাড়া পীরপ্রথা প্রতিষ্ঠা পাওয়া কঠিন৷