মাহী বি. চৌধুরী এবার তাঁর পিতার সর্বশেষ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের প্রায় অর্ধেক ভোট পেয়েছেন। রানিং এমপি থেকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে এতো কম ভোট পেয়ে জামানত হারানোর নজির খুব বেশি থাকে না। তার দাদা খ্যাতনামা আইনজীবী কফিল উদ্দিন চৌধুরী (বিএ ও বিএল) যুক্তফ্রন্টের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের যোগাযোগ, আইন ও বন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭০ সালেও তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে শ্রীনগর, সিরাজদিখান ও লৌহজং নির্বাচনী এলাকার পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি নিজের গ্রামে কফিল উদ্দিন চৌধুরী ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কৃষক প্রজা পার্টির সহ-সভাপতি এবং যুক্তফ্রন্টের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রস্তাবক ছিলেন। মাহীর চাচা যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এমএস করা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার একিউএম শামসুদ্দোহা চৌধুরী পরে ব্যবসা করেও শিল্পপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
মাহীর পিতা একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে যুক্তরাজ্য থেকে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস লন্ডন, এডিনবার্গ ও গ্লাসগো থেকে নির্বাচিত ফেলো-এফআরসিপি এবং এফসিপিএস। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন অধ্যাপনা দিয়ে। তিনি ষাটের দশকের শেষের দিকে জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান ‘আপনার ডাক্তার’ এর উপস্থাপক ছিলেন। তাঁর অনুষ্ঠানের কারণে দেশে শাক সবজি খাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। তিনি ১৯৭৭ সালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমানের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৭৯ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি জিয়াউর রহমান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের উপনেতা নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। বিএনপির মনোনয়নে তিনি একবার ঢাকা-৬ ও চারবার মুন্সিগঞ্জ -১ (শ্রীনগর-সিরাজদিখান) নির্বাচনী এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিএনপি সরকারের সময় তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সংস্কৃতি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিএনপিতে থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদের সরকারী ও বিরোধী দলের উপনেতা ছিলেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব ত্যাগ করে ১৪ নভেম্বর ২০০১ তারিখে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর মাজারে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে বিএনপির সাথে তাঁর মতবিরোধ ঘটলে তিনি ২১ জুন ২০০২ তারিখে বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে বিকল্পধারা বাংলাদেশ নামের একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে এর সভাপতি হন। তিনি রাজনীতি ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে সুনামের সাথেই বিপুল ভূমিকা রাখছিলেন। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বাইরে যে কয়েকজন রাজনীতিবিদের সুনাম দেশজুড়ে ছিল তাদের একজনও ছিলেন তিনি।
মাহীর বড় বোন মুনা চৌধুরী ব্যারিস্টার এবং ছোট বোন শায়লা শারমিন চৌধুরী চিকিৎসক। পিতার খ্যাতির উপর ভর করে মাহী বি. চৌধুরী একজন তরুণ রাজনীতিবিদ হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি বাগ্মী ও টিভি ব্যক্তিত্ব হিসেবেও কিছুটা খ্যাতি পান। যতটুকু জানা যায় তিনি বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিকে অকৃতকার্য হয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকায় চলে যান। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তাক্লারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রির জন্য আমেরিকা যাওয়াও বিরল ঘটনা। আবার আমেরিকাতে দীর্ঘদিন থাকায় তার জনমানুষের সাথে ব্যক্তিগত ঘণিষ্ঠতাও তৈরি হয়নি। আমার সাথে তাঁর তিনবার দেখা হয়েছে। প্রথমবার ছিলেন পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত ও মুখে দাড়ি সম্বলিত অবস্থায় একদল যুবকের সাথে যাদের আমি চিনি। দ্বিতীয়বার দেখা হাফপ্যান্ট পরিহিত অবস্থায়। তৃতীয়বার স্যুট পরা অবস্থায় একটি অনুষ্ঠানে যেটা আমি উপস্থাপন করেছিলাম এবং পরে তাঁর সাথে কিছু কথা বলেছিলাম। তিনি অস্থির চিত্তের ও অদূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ বলেই মনে হয়েছে। তিনি শ্রীনগরের রাজনীতিতে কোনরূপ প্রভাব বলয়ই তৈরি করতে পারেননি। তিনি নিজের দলকেও সংগঠিত করেননি। তবে তারা সন্ত্রাস নির্ভর রাজনীতিও করেননি৷ মাহীর বিরুদ্ধে বিএনপির বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলায় ভূমিকা রাখার অভিযোগ রয়েছে৷
মাহী মুন্সিগঞ্জ-১ নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রথমবার বিএনপির মনোনয়নে উপনির্বাচনে, দ্বিতীয়বার বিকল্পধারা থেকে উপনির্বাচনে এবং তৃতীয়বার নৌকা প্রতীকে মহাজোট থেকে জাতীয় নির্বাচন করে বিজয়ী হন। বিকল্প ধারার সাংগঠনিক সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। ‘সাবাস বাংলাদেশ’ নামে টিভি অনুষ্ঠান প্রচার করে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে ভূমিকা রাখেন। তবে এর নেপথ্যে ছিলেন বি. চৌধুরী৷ মাহীর স্ত্রী আশফাহ হক লোপা অভিনেত্রী ছিলেন। মাহীর খালাতো বোন সমী কায়সারও অভিনেত্রী। তাঁর খালা পান্না কায়সারও এমপি ছিলেন আর খালু শহীদুল্লাহ কায়সার ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী। শহীদুল্লাহ কায়সার আবার জহির রায়হানের ভাই। এতো কিছু বলছি এ কারণে যে, তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ব্যাপক ভূমিকা রাখার মতো সহায়ক পরিবেশ পেয়েছেন জন্মসূত্রেই। এমন পরিবার থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক প্রকৃত মেধার পরিচয় বহন করে না। বিক্রমপুরে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে যে, বি. চৌধুরীর সংকটের স্রষ্টা মাহী! বি. চৌধুরীরর রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে ঢাকা মাওয়া সড়কে শেখ হাসিনার জন্য অসংখ্য তোড়ন নির্মাণ বিএনপির কেউ ভাল চোখে দেখেনি। বিরোধী দলের নেতাকে এমন সংবর্ধনা সরকারি দল দিবেই বা কেন? এটার দায় গিয়ে পড়ে বি. চৌধুরীর উপর। এরপর বি. চৌধুরীর দুটি ঘটনাও বিএনপির মধ্যে সন্দেহ বাড়িয়ে দেয়। জিয়ার সমাধীক্ষেত্রে পুষ্পার্পন করতে না যাওয়া এবং খালেদা জিয়া বিদেশ থেকে এলে নাকি তার খোঁজও নেননি। যদিও প্রথা হল, প্রধানমন্ত্রীই রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎ করে বিস্তারিত অবহিত করবেন। কিন্তু বাস্তবতা হল, রাষ্ট্রপতিই নাকি আগে খোঁজ নেন। এগুলো শুনেছিলাম সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একজন এপিএসের কাছ থেকেই। কেউ কেউ দাবী করেন বি. চৌধুরী এমনটা করেছিলেন নাকি তার পুত্রের কথায়।
তাঁর বিরুদ্ধে দুদকের তদন্তের বিষয়গুলো ছিল বিস্ময়কর ও বিপুল অর্থের। দুদক সেই তদন্ত কি থামিয়ে রেখেছে নাকি নিষ্পত্তি করে দিয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে আমি অবাকই হয়েছিলাম অভিযোগের তালিকা দেখে। পত্রিকায় সংবাদ এসেছিল, মাহী বি. চৌধুরী ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থপাচার ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা একটা ফাঁদ যাতে মাহী আটকা পড়েছেন। ফলে তিনি টকশোতেও গুরুত্ব হারিয়েছেন বা যেতে পারছেন না যাতে এসব প্রশ্নের সন্মুখীন না হন। তাঁর কোন লেখা আমি কখনোই পড়িনি এমনকি দেখিওনি। এক সময় ফেসবুক ফ্রেন্ড ছিলাম তাতেও গুরুত্বপূর্ণ কোন লেখা দেখিনি। তার কোন বই বা কলামও চোখে পড়েনি। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তাঁর কোন গান, আবৃত্তি, অভিনয় দেখিনি বা শুনিনি। তাতে মনে হতো তার ভীতটা হলেন তার পিতা বি. চৌধুরী ও দাদা কে. চৌধুরী। তিন বার এমপি হলেও এলাকার জনমানুষের সাথে কোন সম্পর্ক গড়ে তুলেননি। সংসদেও সক্রিয় ছিলেন না৷ এমনকি তার রাজনৈতিক দলেরও কোন কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি। তার স্ত্রীকে তিনি শ্রীনগর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি করলেও তা টিকিয়ে রাখতে পারেননি। পরে স্যার জগদীশচন্দ্র ইন্সটিটিউশন ও কলেজের গভর্ণিং বডির সভাপতি করেন। সভাপতি হওয়ার পরেই তিনি প্রিন্সিপালকে মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত করেন। স্কুলটিতেও তারা ভাল কিছু করতে পারেননি। মাহীর বিরুদ্ধে ভাগ্যকুলের জমিদার রমেন্দ্রনাথ রায় (সাহেব বাবু) এর একটি ২৫ একরের বাড়ি ক্রয় ও ৫ একরের পুকুর ভরাটের অভিযোগ রয়েছে। জমির বিক্রেতার বিরুদ্ধে জমিদারদের ভুয়া ওয়ারিশ সেজে দলিল করার অভিযোগ রয়েছে। মাহীর দুই বোনও নির্বাচনী এলাকায় পরিচিত নন।
তাহলে বিক্রমপুরের শ্রীনগরের মজিদপুর দয়হাটার বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারের রাজনীতির পরিণতি কী? রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যেও কফিল উদ্দীন চৌধুরী ও বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিপুল সুনাম নিয়েই রাজনীতি করেছেন। তৃতীয় পুরুষেই কি চৌধুরী পরিবারের রাজনীতি শেষ হয়ে গেল? নাকি আবারো উত্থান ঘটবে মাহী বি. চৌধুরীর বা পরিবারের অন্য কারোর? বি. চৌধুরীও শুরুতে চাননি তার পরিবারের কেউ উত্তরাধিকারসূত্রে রাজনীতিতে আসুক। বি. চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হলে তাই তার আসনে প্রার্থী হতে অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠেন। ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী আক্কাস নাদিম ভাইও আগ্রহী। হুমায়ুন আজাদের সাথে তখন আমাদের খুব ঘণিষ্ঠতা। নাদিম ভাই আগ্রহের বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, ‘বি. চৌধুরী তোমাদের কাউকেই প্রার্থী করবে না, সে তার পুত্রকেই মনোনয়ন দিবে। তাঁকে তোমরা চিনো না৷ সে পকেটে চাকু নিয়ে ঘুরে।’ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হুমায়ুন আজাদের কথাই সত্য হয়েছিল। তবে চাকুর কথা কেন বলেছিলেন? ডাক্তারের কাছেতো চাকু থাকবেই৷ নাকি জিয়ার মৃত্যু না ভবিষ্যৎ অনুমান করেছিলেন? বি. চৌধুরী জীবিত থাকা কালেই দেখে গেলেন, তার পুত্রের রাজনৈতিক পরাজয় ও ব্যর্থতা। মাহী চলমান এমপি থেকেও ১৮ হাজারেরও কম ভোট পেয়ে হয়েছেন তৃতীয় এবং কোনরূপ প্রতিদ্বন্দ্বিতাও গড়ে তুলতে পারেননি। যদি বি. চৌধুরী নিজের প্রথম সিদ্ধান্তে ঠিক থাকতেন, মাহীকে আরো পরিণত হওয়ার সুযোগ দিতেন তাহলে হয়তো এমনটা তাঁকে দেখে যেতে হতো না। রাজনীতিতে চৌধুরী পরিবারের শেষটাই দেখছেন অনেকে।