লিখিত বক্তব্যে মুনতাসীর মামুন বলেন, পাঠক্রম নিয়ে বিতর্ক চলছে আজ প্রায় ৮০ বছর। বঙ্গবন্ধুর সরকার ছাড়া কোনো সরকার শিক্ষা সংক্রান্ত নীতি বা পাঠক্রম দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ধর্মকে যখন পাঠক্রমের কেন্দ্রে আনা হয়, তখনই সংঘাত, বিরোধ, বিতর্ক শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় এসে ‘কুদরত-ই-খুদা’ শিক্ষা কমিশন করতে পেরেছিলেন, যেখানে সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি যেন প্রতিফলিত হয়, পাঠক্রমে তার সুপারিশ করেছিলেন।
দুঃখের বিষয় পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে গত ৭৮ বছরে শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য ১১টি কমিশন বা কমিটি হয়েছে। কোনো কমিশনের রিপোর্ট গৃহীত হয়নি। বরং ১৯৭৪ সালে যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, তা বাতিল করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, ১৯৭৮ সালের চার নীতি বাতিল ও ধর্ম শিক্ষার ওপর গুরুত্ব, ১৯৮৮ সালের ধর্ম ও নৈতিকতার ওপর গুরুত্ব, ১৯৯৭ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও অসাম্প্রদায়িতকতা, ২০০৩ সালের ধর্মীয় নৈতিকতা, ২০০৭ সালের অসাম্প্রদায়িকতা তবে চার মূলনীতি নয়।তিনি আরো বলেন, শেখ হাসিনা যখন জঙ্গিবাদের সঙ্গে হেজাবিদের ছাড় দেওয়া বন্ধ করলেন, তখনই শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁদের হস্তক্ষেপ বন্ধ হলো এবং ডা. দীপুমনি পাঠক্রম নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে পারলেন। নির্বাচনের সময় হেজাবিদের প্রভাবে আমরা দেখলাম নতুন পাঠক্রমের বিরোধিতা শুরু হলো। ৭ম শ্রেণির ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ের শরীফা গল্প নিয়ে তাঁরা মাঠে নেমেছেন। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক তৃতীয় লিঙ্গের এই গল্প নিয়ে যা করেছেন, তা উদ্ধত আচরণ, অশিক্ষকসুলভ তো বটেই। ছাত্ররা যদি এ ধরনের মনোভঙ্গি লাভ করে, তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গোটা সমাজের জন্য উদ্বেগজনক।যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা একজন মুক্তিযোদ্ধা, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কনিষ্ঠ একজন শিক্ষকের একি অশিষ্ট আচরণ! কর্তৃপক্ষের উচিত কীভাবে তিনি সেখানে নিয়োগ পেলেন, তা খতিয়ে দেখা। এটি যে পরিকল্পিত বোঝা যায় পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ঘটনা থেকে। আসিফের বক্তব্য একই সঙ্গে ধর্মের অপব্যবহার, অশিক্ষকসুলভ এবং অবশ্যই সংবিধানবিরোধী। তাঁর উপযুক্ত শাস্তি না হলে, এ ধরনের প্রবণতা বাড়তে পারে।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, এবার সংসদে তৃতীয় লিঙ্গের একজন প্রতিনিধি দেখতে চাই। থার্ড জেন্ডার নিয়ে পাঠ্য বইয়ের ভুল-ভ্রান্তি ধরা হয়নি। সেদিনের আলোচনার মূল বিষয় ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ও সমতাভিত্তিক পাঠ্যক্রম তাঁরা চায় না। এক হাজার মাদ্রাসায় গিয়ে দেখেছি, সেখানে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না। এটা নাকি ধর্মবিরোধী। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে এ ধরনের মৌলবাদ ছড়িয়ে পড়লে দেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে না। সব মাদ্রাসায় পরিণত হবে। কোরআনের শাষণ দিয়ে তো বাংলাদেশ চলবে না। আমাদের আইন ও সংবিধান আছে। এর আলোকে দেশ পরিচালিত হবে। আমাদের দেশ অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমর্থন করে।
পাঠ্যপুস্তকে মুদ্রণ ও তথ্যগত যেসব ভ্রান্তি আছে, তা দ্রুত নিরসনের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো অবস্থায় মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির দাবি মেনে কোনো রচনা বা বিষয় প্রত্যাহার বা পরিবর্তন করা যাবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক মাহফুজা খানম বলেন, স্বাধীনতার যে আশা আকাঙ্ক্ষা ছিল, তার ওপর ভিত্তি করে নতুন শিক্ষাক্রম গঠিত। যারা এই শিক্ষাক্রমকে ধর্মবিরোধী বলছেন- বিরোধিতা করছেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। যে অসাম্প্রদায়িক দেশে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধ আছে, সেখানে মৌলবাদী শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে দেশকে ৭১ সালের আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে চাইছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরো বক্তব্য দেন করেন কলামিস্ট মমতাজ লতিফ ও আইনজীবী সামসুদ্দিন মানিক।