গত শুক্রবার আকস্মিকভাবেই এক বন্ধু বলল, ‘আপনাদের রবীন্দ্রনাথ তো চোর! সেতো লালনের সুর চুরি করে আমার সোনার বাংলা লিখেছে।’
বললাম, ‘আপনি ভুল করছেন, গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানের সুর চুরির অভিযোগ উঠাচ্ছে একটি চক্র।’ ওনি সাথে সাথেই স্যুয়িং করে চলে গেলেন গগন হরকরাতে— হ্যাঁ! হ্যাঁ গগন হরকরার সুরই চুরি করেছে।
তবুও বলি, সুর দুটি মিলিয়ে শুনুন ১০-২০% মিল পাবেন বটে। পল্লীগীতির সুরগুলোর মধ্যেও একটা মিল পাবেন। সেটা দক্ষিণ আফ্রিকার হোক বা কেরালার হোক। তাই বলেতো কেরালার সুর বাংলাদেশের পল্লীগীতির সুরকারগণ নকল করে করেননি। লালন, গগনসহ কুষ্টিয়াতে বহু বাউল দল ছিল। রবীন্দ্রনাথ গগন হরকরার গানও শুনেছেন। ‘আমার সোনার বাংলা’ বাউল সুরে গাওয়া বলে গগন হরকরার সুরের সাথে মিল রয়েছে। ওনি মানবেন না— না না অজুহাত দিবেন না, এটা হুবহু চুরি।
ফরহাদ মজহার ও সলিমুল্লাহ খানরা আমার সোনার বাংলা গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত করার বিরুদ্ধে বিস্তর কথা বলেন। মূলত হিন্দু লেখকের গান মুসলিম প্রধান দেশের জাতীয় সংগীত এটাই তাদের আপত্তির মূলে। তারা বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ উঠিয়ে প্রমাণ করতে চায় যে, রবীন্দ্রনাথ মুসলিম বিরোধী ছিলেন। বাস্তবিক রবীন্দ্রনাথ হিন্দুও ছিলেন না, তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের। ধর্মটি আজ হিন্দু ধর্মে প্রায় বিলীন। আমার সোনার বাংলায় গগনের বাউল সুর থাকায় চুরি মনে হচ্ছে, এটা অজুহাত নয়। ওনি রাগ করে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে এসে বললেন, রবীন্দ্রনাথকে তো প্রশ্নও করা হয়েছিল যে, গানটি গগন হরকরার সুর চুরি করে করা হয়েছে। যদি মিল স্বীকারই করেন তবে তিনি সুর চুরি করেছেন তা স্বীকার করলেন না কেন? তবুও বলি, হুবহু নকল নয় বলেই স্বীকৃতি হয়তো দেননি। ওনি আবার রেগে চলে গেলেন এবং ফিরলেন দ্বিতীয় অভিযোগ নিয়ে যে, রবীন্দ্রনাথ আইরিশ গান নকল করে গীতাঞ্জলি লিখেছেন।
বললাম, আধ্যাত্মিক গীতি কবিতার মধ্যে মিল থাকতেই পারে তবে আইরিশ কোন কবির লেখা হুবুহ নকল করে লিখেছেন সেটাও সত্য নয়। গীতাঞ্জলির কবিতাগুলো হয়তো ১০-১১ সালের মধ্যে লেখা। ১৯১২ সালেতো ইংরেজিতেই অনুবাদ করেছেন কবি ইয়েটস ও তিনি মিলে। রবীন্দ্রনাথ কবিতাগুলো লিখেছেন বাংলাতে বসেই। এটা তার লেখার ও জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ফলে নকল করার কারণ নেই। একই সময়ে বহুজনই মাইক্রোওয়েভ নিয়ে কাজ করেছেন তাই বলে কেউ কারোটা চুরি করেননি। শেষ পর্যন্ত মার্কনি এগিয়ে ছিলেন বলেই স্বীকৃতি পেয়েছেন, জগদীশ পাননি। রবীন্দ্রনাথও গীতি কবিতাকে একটি বিশেষ উচ্চতায় নিতে পেরেছেন বলেই নোবেল পেয়েছেন। এরমধ্যে আরিফ শিকদার ও মাসুদ খানও ওই ভদ্রলোকের মিথ্যা দাবী খণ্ডন করেছে। আরিফ বলল, নোবেল কমিটি কি এতোটাই বোকা যে, কিছু না বুঝেই তা দিয়ে দিয়েছে?
আবারো ফিরে এসে তিনি একটি প্রশ্ন ছুড়লেন, রবীন্দ্রনাথ কি বাংলা সাহিত্যে না ইংরেজি সাহিত্যে নোবেল পেয়েছে? বললাম, তিনি বাঙালি কবি। গীতাঞ্জলিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার কারণেই নোবেল কমিটির নজরে এসেছে, তারা পড়ে সিদ্ধান্ত দিতে পেরেছেন। লেখকদের লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ অহরহই হয় এবং অনুবাদের পরেই তারা মূলত নোবেল পান। এটা বিশ্বসাহিত্যের অংশ এখন তবে অবশ্যই তিনি নোবেল পেয়েছেন বাংলা সাহিত্যে লেখার জন্যই। তিনি মানবেন না। সিনক্রিয়েট করে বললেন, এতো বড় কাব্যগ্রন্থটি আমার কাছেই থাকে। হাত দিয়ে দেখালেন তাতে হাজার পৃষ্ঠা হবে। আমরা তার প্রজ্ঞা দেখে অবাক হলাম। আমি বললাম, এটাতো একশ পৃষ্ঠারই কম ছোট একটি কাব্যগ্রন্থ। গুগল থেকেও মাসুদ খান দেখালো বইটি কিন্তু তিনি মানলেন না। বললাম, আপনি সম্ভবত গীতবিতানের কথা বলছেন। তিনি রেগে গেলেন। আমরা বুঝলাম, গীতাঞ্জলি নিয়ে এমন জ্ঞান রেখে তিনি এসেছেন বিতর্ক করতে! রবীন্দ্র বিদ্বেষিরা এমনই৷
পরদিন সন্ধ্যায় একটি পাঠচক্রে আরেকজন, বরীন্দ্রনাথের সমালোচনা করতে গিয়ে, টেনে আনলেন গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতা করার কাল্পনিক গল্প। ওনাকে এর ব্যাখ্যাটি আগেও একবার দিয়েছিলাম। আবারো দিলাম, যে আয়োজকগণ পত্রিকায় যে বিজ্ঞাপন ছেপেছিল সেটাতে রবীন্দ্রনাথের নাম ছিল। সেটাতো নিশ্চিত করে না যে, রবীন্দ্রনাথ প্রোগ্রামে ছিলেন। পরদিন পত্রিকাতে ওই অনুষ্ঠানের যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাতে, রবীন্দ্রনাথের নাম ছিল না। দ্বিতীয়ত তিনি ওই অনুষ্ঠানের আগের দিনও শিলাইদহে বসে কবিতা লিখেছেন। সেই তারিখ ও স্থান দেয়া কবিতা রয়েছে৷ এর মানে এই যে, রবীন্দ্রনাথ গড়ের মাঠের ঢাবির বিরুদ্ধে কোন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেননি। যে রেফারেন্সই দুর্বল বা ভুল তা দিয়ে যুক্তি দেয়া যায় না। আড্ডায় বা পাঠচক্রে একই কথা বহুবারই বলতে হয়। এর কারণটি বুঝতেই আলোচনা করি আব্দুর রহমান ও সুদীপ্ত সাহার সাথে। কেন এমন প্রচারণা। আমরা অভিযোগকারী স্থানীয়দের স্টাডি না থাকার বিষয়টা জানি। তারা হয়তো কোন ইউটিউবে রবীন্দ্রবিরোধীতা দেখে তা মুখস্থ করে রেখেছেন। এমন জায়গা থেকে কেবল যুক্তি দিয়ে তাদের বের করা যাবে না। সাম্প্রতিক সময়ে সলিমুল্লাহ খান ও ফরহাদ মজহার রবীন্দ্র বিরোধীতা অহরহই করেন অত্যন্ত দুর্বল যুক্তি দিয়ে। যেমন সলিমুল্লাহ কখনো বলেন আহমদ ছফা রবী ঠাকুরের চেয়ে অনেক বড় লেখক আবার কখনো বলেন, রবীন্দ্রনাথ লালনের পায়ের নখের যোগ্যও নন। তাতে রবীন্দ্র বিরোধীরা উল্লসিত হয়ে মিথ্যা তথ্য নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে চান। তাদের আচরণে সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশই পায়। নববর্ষ আসলে জাতীয় সংগীত ও মঙ্গল শোভাযাত্রা দেখে তাদের দুঃখটা বেড়ে যায়৷ ঘোরের মধ্যে একই প্রলাপ বকতেই থাকেন৷