ঝিনাইদহ ০৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের রহস্য নতুন মোড় নিয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডে ইন্ধনের অভিযোগে গতকাল আটক করা হয়েছে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে। বিকাল ৪টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতার বাসার সামনে থেকে তাকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। মিন্টুকে ডিবির মিন্টো রোড কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়েছে।
এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহিনের সঙ্গে যোগাযোগ, গ্রেপ্তার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য এবং প্রযুক্তির সহায়তায় প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মিন্টুকে আটক করা হয়েছে। ঝিনাইদহের আরও কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকেও আটক করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র। তারা বলছেন, হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো শাহিনের সঙ্গে মিন্টুর যোগাযোগ ছিল। এ ছাড়া গ্রেপ্তার হওয়া ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুর সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল তার। এসব বিষয়ে মিন্টুকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে ডিবি। রিমান্ডে থাকা বাবুর মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে মিন্টুকে।
গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আনারের কারণে এমপি হওয়ার স্বপ্ন অধরা থেকে যায় মিন্টুর। এ ছাড়া রাজনৈতিক কারণে আনারের সঙ্গে তার দূরত্ব ছিল। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মিন্টু ঝিনাইদহ ০৪ আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। এ ছাড়া গত বছর বিতর্কিত কিছু বিষয়ের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যার কারণে দলে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় মিন্টুকে। এ ঘটনার জন্যও আনার দায়ী বলে মনে করেন মিন্টু। গত আগস্টের শেষ সপ্তাহে এ ব্যাপারে ঝিনাইদহে একটি সংবাদ সম্মেলন করা হয়, যেখানে পরোক্ষভাবে আনারকে দায়ী করা হয়। গত সংসদ নির্বাচনে আনারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন মিন্টু। আনারের সঙ্গে মিন্টুর এই দূরত্বের বিষয়টি জানা ছিল খুনিচক্রের। চক্রটি তাই আনারকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে মিন্টুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। মিন্টুও এ বিষয়ে খুনিচক্রকে ইন্ধন দিয়েছিল বলে গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে।
ঝিনাইদহের স্থানীয় সূত্রগুলো বলেছে, গত ২২ মে আনার খুন হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর আনারের বাড়িতে শুধু একদিনই গিয়েছিলেন মিন্টু। সেদিন সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন তিনি। এরপর আনার খুনের বিচার দাবিতে ঝিনাইদহে অনুষ্ঠিত কোনো কর্মসূচিতেই তাকে দেখা যায়নি। এটা নিয়ে আনারের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে নানা প্রশ্ন জন্ম নেয়।
খুনের পর চরমপন্থি নেতা শিমুল বাংলাদেশে যে কজনকে ফোন করেছিলেন, তাদের মধ্যে মিন্টুও আছেন। কেন তাকে ফোন করা হয়েছিল? তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল? এসব বিষয়ে পুুলিশের কাছে মুখ খুলেছেন শিমুল। পুরো বিষয়টিতে মিন্টুর ভূমিকা খুবই সন্দেহজনক। এই রহস্য ভেদেই মিন্টুকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন তদন্ত কর্মকর্তারা।
ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, এমপি আনার হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার শিমুল ভূঁইয়ার জবানবন্দিতে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নাম সামনে এসেছে। শিমুলকে জিজ্ঞাসাবাদে স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের পাশাপাশি রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের বিষয়টিও প্রকাশ্যে এসেছে এতদিন পর্যন্ত যা আনার হত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখে আসছিল ডিবি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ গতকাল দুপুরে বলেছিলেন, আনার হত্যাকাণ্ডের পর আসামিরা কাকে কাকে ছবি ও ভিডিও শেয়ার করেছে, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। সেখান থেকে কেউ আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন কিনা, হয়ে থাকলে কাদের মাধ্যমে হয়েছেন এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, আনার হত্যাকান্ডে ঝিনাইদহের কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তার এ বক্তব্যের পরপরই বিকালে মিন্টুকে আটক করা হয়।
ডিবিপ্রধান আরও বলেন, তথ্য-উপাত্ত বিচার বিশ্লেষণের পরই গ্যাস বাবুকে গ্রেপ্তার এবং পরবর্তীকালে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তাকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি। বাংলাদেশ ও ভারতে গ্রেপ্তার আসামিদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আমরা কথা বলেছি। মূল ঘাতক শিমুলসহ অন্যরা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন, মাস্টারমাইন্ড শাহিনের ব্যবহৃত দুটি গাড়িও জব্দ করা হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, আনার হত্যাকাণ্ডে ঝিনাইদহের আরও ৪ থেকে ৫ নেতা গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন। যে কোনো মুহূর্তে তাদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে। আনারের পরিবারের পক্ষ থেকে তার কন্যা মুনতারিন ফেরদৌস ডরিন ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই বাবুকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়। মাস্টারমাইন্ড শাহিনের সঙ্গে মিন্টুরও যোগাযোগ ছিল।
ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সফিকুল ইসলাম অপু বলেন, দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে জেলা আওয়ামী লীগের একটি অনুষ্ঠান ছিল মঙ্গলবার (গতকাল)। সেই অনুষ্ঠানে মিন্টু আসেননি। ঘটনার সঙ্গে যে ই জড়িত থাকুক, তাকে গ্রেপ্তার করার আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে গতকাল এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, আমরা কখনোই বলিনি, আনার চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সবসময় বলে আসছি, সেটি সন্ত্রাসপূর্ণ একটি এলাকা। ওখানে সত্যিকারে কী হয়েছে, আমাদের জানতে হবে। আমরা তদন্ত করছি। তদন্তের পর আপনাদের সবকিছু জানাব।
আনারের মেয়ে ডরিন তার বাবার খুনে কতিপয় সন্দেহভাজনের নাম বলেছেন। কারা রয়েছেন সে তালিকায়, এমন প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তদন্ত না করে কোনো কিছু বলা সম্ভব না। আমরা মনে করি তদন্ত শেষে এগুলো নিয়ে কথা বলা উচিত।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট