ইউরোপ-আমেরিকায় পরিত্যাক্ত বহু গীর্জাই বিক্রি হয়েছে৷ এশিয়া-আফ্রিকা থেকে যাওয়া উদ্বাস্তু মুসলিমরা কষ্টার্জিত টাকায় বন্ধ হওয়া কিছু গীর্জা কিনে মসজিদ বানিয়ে উল্লাস করছে৷ তারা ভেবে নিয়েছে খ্রিস্টানদের পরাজিত করে তারা বিজয়ী হচ্ছে৷ খ্রিস্টানরা হয়তো ভাবছে, আমরা যা অর্থহীন ভেবে ত্যাগ করেছি তা এরা গ্রহণ করে আরো বহুকাল পশ্চাৎপদ থাকবে! আমেরিকার বহু ক্যাথলিক গির্জা মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। কেমব্রিজের সেইন্ট পিটার্স ক্যাথলিক চার্চের স্থানে গড়ে উঠেছে ‘মদিনা মসজিদ’। জনসমাগম কমে যাওয়ায় গির্জাটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। গির্জার মুখপাত্র তখন বলেছিলেন, এই গির্জাটির রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর ভক্তের সংখ্যা খুবই কমে গিয়েছিল। ফ্রান্সের বিখ্যাত এমানুয়েল মুনিয়ার, জ্যাক মরিটেনন, তেনলহার্ড় ডি চার্ডিনসহ বহু গির্জার স্থানে মসজিদ, শো-রুম ও শপিং মল গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন খবরে আমরা জানতে পারি, খ্রিস্টান উপসনাগুলো ভেঙে সেখানে পার্কিং ব্যবস্থা, রেস্তোরাঁ, বুটিক, বাগান ও ঘরবাড়ি গড়ে উঠেছে। ইউরোপে ভক্তের অভাবে বহু খ্রিস্টান ধর্মীয় ভবন উচ্ছেদ করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও ফ্রান্সে ৪০ হাজার যাজক ছিলেন। এখন নেমেছে ৮ হাজারে। অনেক গির্জা ভেঙে গড়ে উঠেছে মসজিদ। সেইন্ট ক্রিস্টোফারের পুরাতন গির্জা কুই মালাকফ নানাটসের স্থানে গড়ে উঠেছে ফোরকান মসজিদ।
ইতিহাসবিদ ডিডিয়ার রিকনার লিখেছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম গির্জাগুলো গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। গত বছর ভিরজনের সেইন্ট-ইলোই গির্জাকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছে।’ গত এক দশকে ফ্রান্স ও জার্মানির বিপুল সংখ্যক গীর্জা উচ্ছেদ অথবা বিক্রি হয়ে গিয়েছে।
কেন বিক্রি বা বন্ধ হচ্ছে? অর্থনৈতিক সংকটে যে হচ্ছে না সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়৷ স্কেন্ডেভিনিয়া অঞ্চলের প্রায় আশি ভাগ মানুষ এখন ধর্ম বিশ্বাস করে না৷ বাকিদেরও উল্লেখযোগ্য অংশ গীর্জামুখী হচ্ছে না৷ জার্মানরাও ক্রমেই ধর্ম ত্যাগ করছেন। প্রতি মিনিটেরও কম সময়ে একজন জার্মানি গির্জায় যাওয়া বন্ধ করে দিচ্ছেন। জার্মানি ইভানজেলিকার চার্চ ১৯৯০ ধেকে ২০১০ সালের মধ্যে ৩০টি গির্জা বন্ধ করে দিয়েছে। বিপ্লবী কার্ল মার্ক্সের শহরে একটি গির্জা জিমে পরিণত হয়েছে। গত দশকে এই হার আরো বেড়েছে৷ ফ্রাঙ্কফুর্টে গত শতাব্দীর ৫০ এর দশকে প্রোটেস্টান্টের সংখ্যা ছিল চার লাখ ৩০ হাজার। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১০ হাজারে। এখনকার এক চতুর্থাংশ গির্জাই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নেদারেল্যান্ডে প্রতি সপ্তাহে দুটি খ্রিস্টান ধর্মীয় ভবন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যাজক জান স্টুইট বলেন, ‘নেদারল্যান্ডে রোববার গির্জায় ক্যাথলিকদের উপস্থিতি ছিল ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯০ শতাংশ। এখন এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশে। নেদারল্যান্ডে প্রতি বছর ৬০টি উপাসনালয় উচ্ছেদ, বন্ধ অথবা বিক্রি হয়ে যায়। ১৯৭০ সাল থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে ২০৫ টি গির্জা উচ্ছেদ করা হয়েছে। এ সময় ১৪৮টি গির্জাকে লাইব্রেরি, রেস্তোরাঁ, জিম, আপার্টমেন্ট ও মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছে। আমস্টারডামে একটি গির্জার জায়গায় গড়ে উঠেছে মসজিদ। শহরের সবচেয়ে পুরনো সেন্ট জ্যাকোবাস গির্জাটিকে বিলাসবহুল বাসভবনে রূপান্তর করা হয়েছে এই শহরের প্রোটেস্টান্ট গির্জাগুলোর সদস্য সংখ্যা প্রতি বছর ৬০ হাজার করে কমেছে। এই হার অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে এখানে আর কোনো প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান থাকবে না।’ গত দশকে ইউট্রেস্টান্ট ও আমস্টারডামের দুটি প্রোটেস্টান্ট গির্জাকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছে। এটাই পাশ্চাত্যের বর্তমান অবস্থা। এগুলো পুরাতন রিপোর্ট৷ হালনাগাদ তথ্য বলছে এখন ইউরোপে ধর্মান্ধতা রয়েছে ইউরোপের বাইরে থেকে আসাদের মধ্যেই৷
বাংলাদেশেও তরুণদের মধ্যে ধর্মবিমূখতা স্পষ্ট৷ আমাদের এলাকার একটি গ্রামের ৯টি মসজিদ নিয়ে একবার তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম৷ ফজরের নামাজ পড়তে গিয়ে আমার এক বন্ধু দেখেন মসজিদ তালা৷ তিনি ডাকাডাকি করে ইমামকে উঠিয়ে বন্ধের কারণ জানতে চান৷ ইমাম তাকে জানায় আমি নিজেই আজান দিয়ে একা একা নামাজ পড়ে শুয়ে পড়ি৷ কেউতো আসে না! আমি অবাক হয়েই অনুসন্ধানটি চালিয়েছিলাম৷ অথচ ওই গ্রামের প্রতিটি মসজিদই আলিশান! এরমধ্যে বাংলাদেশে সরকার ৫০০ মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে৷ অনেক স্থানেই মসজিদ নির্মিত ও উদ্বোধন হয়েছে৷ কেউ অনুসন্ধান করতে পারেন৷
কিন্তু ইরানের একটি সংবাদে বিস্মিত হলাম৷ বিশ্ব মিডিয়াতে সংবাদটি ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলেও বাংলাদেশে ব্লাক আউট করা হয়েছে৷ ইরানে ৬০% মসজিদ বন্ধ হয়ে গেছে মুছুল্লির অভাবে! একজন ধর্মীয় নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন৷ সেই সোর্সেই সংবাদ৷ মানে মাশা আমিনির মৃত্যু পরবর্তী আন্দোলনের আগেই ইরানের নাগরিকরা ধর্মান্ধতা থেকে বেরিয়ে আসা শুরু করেছিল৷ তবুও ইরানে ৫০ হাজার মসজিদ মুছুল্লির অভাবে বন্ধ হওয়া অবিশ্বাস্যই৷ এটাকি শুধু ইরানেই ঘটছে? নাকি বিশ্বজুড়েই সেমিটিক ধর্মবিশ্বাস ফিকে হয়ে আসছে? কি হবে যদি ফাদার বা ইমাম বা পুরোহিত একাএকা ধর্মীয় উপাসনা করে? তাহলেতো আজ যারা কিনছে কাল তাদেরও বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দিবে?
মানুষের ধর্মবিশ্বাস দ্রুতই ফিকে হয়ে আসছে। মেট্রোপলিটান শহরাঞ্চলে পরিচালিত একটি গবেষণার তথ্য দেখলাম। তাতে বলা হয়েছে প্রতি বছর ৩% মানুষ ধর্মবিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে খুবই দ্রুত হারে মনুষ ধর্মবিশ্বাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারসহ বহু প্রতিষ্ঠানই এর কারণ অনুসন্ধান করেছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯০ এর পরে রিপাবলিকানদের দ্বারা ধর্মীয় অজুহাতে সমলিঙ্গ-বিবাহ ও গর্ভপাত বিরোধী অবস্থান নিলে তরুণরা বিরক্ত হয় এবং তারা ধর্মের প্রতি বিমুখ হয়। গত এক দশকে ক্যাথলিক যাজকদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের তথ্যগুলো প্রকাশিত হয়। মানুষ এগুলোর বিষয়ে সচেতন হয় এবং তারা মনে করে চার্চে এমন অপকর্ম এখনো হচ্ছে। আরেকটি জরিপে দেখায় যেসকল দেশে ধর্মবিশ্বাস প্রবল সেসকল দেশে দুর্নীতিও একই মাত্রায় প্রবল। সারা পৃথিবীতে কি কি কারণে মানুষ ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারাচ্ছে তা নিয়েও অনেক গবেষণা হয়েছে। ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা একসময় মানুষকে ধর্মে আচ্ছন্ন করে রাখতো। এখন এ বিষয়ে মানুষ সচেতন। কেউ দাবী করেন, ধর্মের সমস্ত তথাকথিত গাইড হল ভণ্ড লিঙ্গবাদী, বর্ণবাদী এবং কৌতুক পুরুষদের লেখা যারা সকালে কেন সূর্য ওঠে তা ব্যাখ্যা করতে পারিনি। ধর্মগ্রন্থের সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো সম্পূর্ণ বিপরীত। পুরোহিত শ্রেণি যতই বলুক যে, এগুলো ধর্ম বই থেকেই এসেছে। কিন্তু মানুষ অত বোকা নয় এখন। তারা ধর্মগ্রন্থ পড়ে দেখছে যে, সেখানে ভুলে ভরা তথ্য রয়েছে এবং এগুলো বিজ্ঞানবিরোধী। অনেকেই ভাবছে, ধর্ম হল ভয়ের মাধ্যমে জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বে এর কোন স্থান নেই। বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক বালকই মাদ্রাসায় বলাৎকারের শিকার হন মর্মে পত্রিকায় রিপোর্ট আসে। এতেও সাধারণ মানুষ ধারণা করে নিচ্ছে ওখানে এমন চর্চা বিপুলভাবেই হয়। এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। তরুণরা দেখছে, মসজিদের ইমামদের সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রায় নাই। এছাড়া শিক্ষিত সমাজ দ্রুতই ধর্মের দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিচ্ছে। ধর্মান্ধ শ্রেণির মানুষ রয়েছে অজ্ঞতার মধ্যে। এক তরুণ আমাকে বলেছিল, সে নিয়মিতই প্রার্থনা করতো যাতে ভাল রেজাল্ট হয়। অথচ ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ করা এক ছেলেই ফার্স্ট হচ্ছিল। এটা তার মধ্যে প্রশ্ন তৈরি করে এবং সে বুঝতে পারে যে, প্রার্থনায় কোন কাজ হয় না। এসব বিষয় কেবল বাংলাদেশেই নয় সারা পৃথিবীর তরুণদের মধ্যেই প্রভাব রাখছে এবং তারা ধর্ম বিশ্বাস ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে ধর্মালয়ে মারাত্মকভাবেই সংকট দেখা দিবে অনুসারীদের। তখন ধর্মালয়গুলো বন্ধ বা বিক্রি করে দেয়া ছাড়া পথও খোলা থাকবে না।