প্রায় ৩০ বছর আগে খুলনায় ফুলতলা গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে গিয়েছিলেন রাজেন্দ্রনাথ ভক্তদাস। সেখান থেকে ব্যাট বানানো শিখে আসেন তিনি। এরপর নিজ বাড়িতে এসে ব্যাট বানানো শুরু করেন। নিজে শিখে এসে তার দুই ভাইকে ব্যাট বানানো শিখিয়েছেন। প্রথমে অল্প কিছু ব্যাট তৈরি করলেও এখন তার ব্যাটের চাহিদা ব্যাপক। কথাগুলো বলছিলেন ক্রিকেট ব্যাট বানানোর কারিগর ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার বাথানগাছি গ্রামের রাজেন্দ্রনাথ ভক্তদাস।
উপজেলার বাথানগাছি গ্রামের শ্যামল ভক্তদাস, রাজেন্দ্রনাথ ভক্তদাস ও অচিন্ত ভক্তদাস গড়ে তুলেছেন ক্রিকেট ব্যাট ও স্ট্যাম্প তৈরির কারখানা।
সরেজমিন বাথানগাছি গ্রামে দেখা যায়, কারখানার ভিতরে ও বাইরে সারি সারি কাঠ পড়ে আছে। দুটি কারখানায় ব্যাট ও স্ট্যাম্প তৈরির কাজ করছে শ্রমিকরা। কেউ মেশিনে, আবার কেউ হাতের কাজে ব্যস্ত। ৭/৮ জনকে ব্যাট ও স্ট্যাম্প তৈরি করছেন। ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের ব্যাট তৈরি করছেন তারা। কাঠ পরিষ্কার থেকে শুরু করে ব্যাট-স্ট্যাম্প খেলার উপযোগী করা পর্যন্ত সবই করেন কারখানার শ্রমিক
ব্যাট তৈরির কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথমে তিন ভাই ব্যাট কারখানা পরিচালনা করতেন। বর্তমানে দুই ভাই দায়িত্বে আছেন। একভাই ব্যাট কারখানা ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
ব্যাট তৈরির এ কাঠ ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন স্থান থেকে তারা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। এরপর বাড়িতে এনে সেগুলো শুকিয়ে নেন। এরপর ব্যাটের সাইজ অনুসারে মেশিন দিয়ে কেটে ব্যাট তৈরি করেন। বিভিন্ন স্টিকার লাগিয়ে সেগুলো বাজারে বিক্রি করেন। শীতকালে ব্যাট বিক্রির চাহিদা বেড়ে যায়। সেসময় দুই কারখানায় প্রায় ২০ জন শ্রমিক কাজ করেন। বর্তমানে মৌসুম না হওয়ায় দুই কারখানায় ৭/৮ জন শ্রমিক দিয়ে ব্যাট তৈরি করছেন মৌসুমে চাহিদা মেটানোর জন্য।
তারা বিভিন্ন সাইজের ব্যাট তৈরি করেন। ১নং সাইজের ব্যাট তৈরিতে খরচ পড়ে ৩০ টাকা। এগুলো পাইকারি বিক্রি করেন ৫০-৬০ টাকা। ২নং সাইজের ব্যাট তৈরিতে খরচ হয় প্রায় ৪০ টাকা। বিক্রি করেন ৭০ টাকা। ৩নং সাইজের ব্যাট তৈরিতে খরচ হয় ৫০ টাকা। পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন ৮০-৯০ টাকা এবং সবচেয়ে বড় সাইজের ব্যাট তৈরিতে খরচ হয় ১৫০ টাকা। এগুলো পাইকারি বিক্রি করেন ২০০-২৫০ টাকা।
একটি ব্যাটে তাদের লাভ হয় ৪০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে প্রতিদিন ৪০-৫০ পিস ব্যাট বিক্রি হচ্ছে। আর মৌসুমে প্রতিদিনি ৩০০-৪০০ ব্যাট বিক্রি হয়।
তিনটি স্ট্যাম্প তৈরিতে খরচ হয় ৩০ টাকা। পাইকারি বিক্রি হয় ৩৫-৪০ টাকা। এ ব্যাট তৈরি করে তিন ভাইয়ের ভাগ্যের বদল হয়েছে। দালান বাড়ি তৈরি, কৃষি জমি কিনেছেন এ ব্যাট তৈরি করে।
ব্যাট তৈরি করা শ্রমিক সনজিৎ শর্মা জানান, তিনি শ্যামল ভক্তদাসের ব্যাট কারখানায় প্রায় ১১ বছর কাজ করছেন। এখানকার ব্যাটের চাহিদা আছে। ঢাকা, ফরিদপুর, রাজশাহী, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ কারখানার ব্যাট যায়। বর্তমানে ব্যাট বিক্রি কম হয়। মৌসুমে ব্যাটের চাহিদা বেড়ে যায়। এখানকার ব্যাটের সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
রেজাউল ইসলাম নামে আরেক শ্রমিক জানান, দীর্ঘ ২০ বছর তিনি এ ব্যাট তৈরির কারখানায় কাজ করছেন। প্রথম দিকে খুব কষ্ট করে এ ব্যাট বানাতে হতো। বর্তমানে কিছু মেশিন আসায় সুবিধা হয়েছে। তাদের বানানো ব্যাটের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। মৌসুমে চাহিদা বেশি থাকায় তা মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। অনেক সময় একসঙ্গে ২-৩ হাজার ব্যাটের অর্ডার আসে। মেশিনের সংকট থাকায় হাতে এত ব্যাট তৈরি করতে কষ্ট হয়।
শংকরহুদা বাথানগাছি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সনজিৎ কুমার বলেন, বাথানগাছির এ ব্যাট কারখানা ঐতিহ্যবাহী হিসেবে গড়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে এটি ব্যাটের গ্রাম হিসেবে পরিচিত পাচ্ছে। এ গ্রামে তৈরিকৃত ব্যাট এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। প্রথমে এ কারখানা ছোট ছিল। এখন বেশ বড় পরিসরে ব্যাট বানানো হচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে, ততই ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে মালিকদের। তাদের মাধ্যমে অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। তারা তিন ভাই আগে বেশ কষ্ট করেছেন। এখন দুই ভাই ব্যাট তৈরি করছেন ও এক ভাই বিদেশে গেছেন।
যশোর থেকে ব্যাট কিনতে আসা ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম বলেন, এখানকার ব্যাট অন্যান্য স্থানের থেকে ভালো। এ ব্যাটের সুনাম আছে। তাছাড়া এখানকার ব্যাটের দামও বেশ কম। এ ব্যাট বিক্রি করলে সুনামও বাড়ে, আবার লাভও বেশি হয়। তিনি টেপ টেনিস ও থ্রি-স্টার বল খেলার জন্য এখানকার তৈরি ব্যাট বিক্রি করেন।
একটি কারখানার মালিক রাজেন্দ্রনাথ ভক্তদাস বলেন, প্রথমে অল্প পরিমাণ কাঠ নিয়ে ব্যাট বানাতেন। এখন প্রচুর কাঠের প্রয়োজন পড়ে। এখানকার ব্যাট এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। ৬ মাস ব্যাট বিক্রির মৌসুম। আর ৬ মাসে ব্যাট তৈরি করে মজুদ করে রাখেন। জনপ্রতি শ্রমিকদের ৫০০ টাকা মজুরি দেন। তিনি টেনিস ও থ্রি-স্টার বল খেলার উপযোগী ব্যাট তৈরি করেন।
কাঠ পেলে তিনি জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের জন্য ব্যাট তৈরি করতে পারবেন। তখন আর তাদের বিদেশি ব্যাট কিনতে হবে না বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আরেক কারখানার মালিক শ্যামল ভক্তদাস বলেন, তার ছোট ভাই ব্যাট বানানো শিখে আসে। এরপর তাদের শেখান। তারপর থেকে ব্যাট তৈরি করছেন। প্রায় ৩০ বছর ধরে তারা ব্যাট বানাচ্ছেন।
মহেশপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ময়জদ্দীন হামীদ বলেন, উপজেলার বাথানগাছি ঐহিত্যবাহী গ্রাম। এ গ্রাম এখন ‘ব্যাটের গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। এ গ্রামে আগে গরুর গাড়ির চাকা তৈরি হতো। চাকা তৈরির কাজ কমে যাওয়ার পর সেখানকার কারিগররা ব্যাট বানানোর কাজ শুরু করে। তারা প্রায় ৩০ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যাট তৈরির কারখানা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট