রাজনৈতিক অন্ধত্ব আমাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব তৈরি করে। আমাদের কল্পনার জগৎ হাতিয়ে নেয়। দল না ন্যায়— জঙ্গিবাদের মতো এটাও মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং অধিক দলান্ধরা ন্যায়ের পথে হাঁটতে পারে না৷ জঙ্গিবাদ কি কেবল বৈশ্বিক রাজনৈতিক সমস্যা ছিল? আমাদের জীবনে কি তা ভীতি তৈরি করেনি? যখন বাংলা হবে আফগান/ আমরা হবো তালেবান শ্লোগান দেয়া হতো তখন কি সচেতন মানুষ মাত্রই ভয়ে কেঁপে উঠতো না? অতি বোকা লোকেরা না হয় গভীরে যেতে পারে না। অন্যরা বুঝিয়ে দিলে বোঝার মেধা তাদেরও আছে। বোঝানোর দায়িত্ব এদেশে কেউ নেয় না৷ অনেক বিস্ময়কর ঘটনাই ঘটে।
গতকাল একজন অতি ধর্মবিশ্বাসী ও নিয়মিত ধর্মীয় আচার পালনকারী ছেলেকে ইসলামপন্থী একটি রাজনৈতিক দলের নেতারা ডেকে নেয়। তারা আহ্বান জানায়, তাদের দলে যোগ দিতে। ছেলেটি বলে, ‘আপনারা কোন দিনই ক্ষমতায় যেতে পারবেন না। সে যোগ্যতা আপনাদের নেই । আর যদি কোনভাবে ক্ষমতায় যানও তবে দেশ চালানোর ক্ষমতা আপনাদের নেই। আপনারা দেশকেই ধ্বংস করে দিবেন। তারচেয়ে স্যেকুলার রাজনৈতিক দল করাও ভাল।’ শুনে আমি বিস্মিতই হলাম। এই ছেলেটি কিভাবে বুঝতে পারলো? বাস্তবিক তার মেধা দিয়েই সে বুঝতে সক্ষম হয়েছে।
আমাদের চিন্তার জগৎ খুবই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আমরা ভাবি আমরাই মেধাবী! আপনাকে যদি প্লাংকের সূত্রের সাথে বিশেষ আপেক্ষিকতার সূত্রের সম্পর্ক বোঝাতে চাই, আপনি কি বুঝবেন? যারা কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়েছেন তারা অনেকেই বুঝতে পারবেন। তাই বলে কি, যারা পড়েনি তাদের মেধাহীন বলবো? আমিতো গান গাইতে পারি না কিংবা ছবি আঁকতে পারি না৷ এখন যে গাইতে ও আঁকতে পারে তার কাছে কি আমি মেধাহীন? একজন কৃষক জানে কিভাবে ধান উৎপাদন করতে হয়। আপনি কি পারবেন, এক বিঘা জমিতে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে? এক্ষেত্রে আপনার চেয়ে ওই কৃষক কি মেধাবী নয়? মেধার মতো শব্দও আমাদের ভয় ধরিয়ে দিতে পারে। আমাদের কল্পনার জগৎ হাতিয়ে নিতে পারে। বাস্তবতা হল দেশের সেরা কবি যে আবার বাংলার ছাত্র তাকে যদি চারুকলার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তবে সে হবে মেধাহীন। তাই কোটাও আমাদের মধ্যে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। কোন একটি ক্ষেত্রে নিজেকে যে দক্ষ করে গড়ে তুলেছে সে কোটার কারণে চাকরি নাও পেতে পারে।
আমাদের ভয় ধরিয়ে দেয় যখন রাজনৈতিক কারণে কেউ বলে বেড়ায়, ওই মৌলবাদ এসে পড়েছে। বাঁচতে পারবে না কেউ, পালাও! তখনও আমরা ভয় পেতে পারি এবং আমাদের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আমরা বিবেচনা ও সচেতনতা দিয়ে হিসাব করার সুযোগ নাও পেতে পারি। আমাদের প্রতিরোধের ক্ষমতাও ভেঙ্গে যেতে পারে। এজন্য দরকার সমাজকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা। কিন্তু যাদের উদ্দেশ্য অসৎ তারা সেটা করবে না। এটা যখন কোন ব্যক্তি করে তখন তা কমই ক্ষতি করে। যদি কোন দল করে তবে দলান্ধরা বিভ্রান্ত হয়ে অধিকমাত্রায় ভীতি তৈরি করতে পারে। যদি কোন রাষ্ট্র করে তখন ক্ষতিটা আরো বেশি হবে। সে এই ভীতি ছড়িয়ে দিতে পারে বিশ্বজুড়ে। আমেরিকার মতো দেশে ট্রাম্প নানা রকম ভীতি ছড়াচ্ছে। এসব ভীতি মার্কিনীদের বিভ্রান্ত করতে পারে।
বাংলাদেশে অসংখ্য ভুয়া ফটোকার্ড বিভিন্ন স্বনামধ্য মিডিয়ার নামে ছাড়া হচ্ছে। যেমন দুই মাসে কেজিতে চালের দাম ৩০/- টাকা বাড়ার ভুয়া ফটোকার্ড। আজ একজন কথিত প্রগতিশীল বন্ধু অনেকগুলো ভুয়া ফটোকার্ড আমার ওয়ালে মন্তব্যের ঘরে পোস্ট করেছেন। তিনি তখনই যাচাই করতেন যদি নিরপেক্ষ হতেন। একটি কার্ডে দাবী করা হয়েছে সারজিস ও আব্দুল্লাহ ১২ কোটি টাকা আত্মসাতের জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করলেন! যমুনা টিভির ভুয়া ফটোকার্ড। এসব মিথ্যাচার আমাদের মধ্যে ভীতি তৈরি করে। আমাদের ভাবনার জগত ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আমাদের সুস্থভাবে চিন্তাও করতে দিবে না। ওরা হাতিয়ে নিতে চায় আমাদের ভাবনার জগৎ। এতে ওদের লাভ রয়েছে।
আমি অনেকের কাছেই জানতে চেয়েছি, এখন যদি ইউনূসকে সরিয়ে দেয়া হয় তাহলে দেশের কি লাভ হবে? দেশের লাভটা তারা দেখাতে পারেন না। কি কি ক্ষতি হতে পারে? দেশ অস্থিতিশীল হয়ে যাবে এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামায় বিপুল লোকের মৃত্যু ঘটবে। প্রবৃদ্ধি ৠণাত্মকও হতে পারে৷ দুর্ভিক্ষও লাগতে পারে৷ এই অরাজকতায় অন্য কেউ ক্ষমতা দখলে নিবে। সেটা সামরিকবাহিনীও হতে পারে। তাহলে দেশ গণতন্ত্রে ফেরার সম্ভাবনা আরো দূরে চলে যাবে। দেশে অন্তত দুটি শক্তিশালী দল দরকার। একটি দল থাকলে তার স্বৈরাচারী হওয়ার সম্ভাবনা আবার বেড়ে যাবে। এসব ভয় আমাদের ভাবনা ক্ষতিগ্রস্থ করে। মিথ্যা ও ভুল প্রচারণার বেসাতি আমাদের বিপ্লবকে আবারো বেহাত করতে পারে। একাত্তরে অর্জিত স্বাধীনতা, নব্বইতে অর্জিত গণ-অভ্যুত্থানের সুফল আমরা ধরে রাখতে পারিনি। আশঙ্কা তৈরি হয়, এবারও কি আমাদের বিপ্লব বেহাত হবে? দেশে আবারো কি স্বৈরশাসন ফিরে আসবে?
দেশ ও আমাদের ভাবনার জগতকে বাঁচাতে হলে স্বৈরশাসনের আগমন ও উত্থানকে ঠেকাতে হবে৷