সুখ তুমি কী বড়ো জানতে ইচ্ছে করে।একজন অট্টালিকায় দামী বিছানায় শুয়েও ঘুমাতে পারে না, ঘুমের বড়ি খেতে হয়।খেয়েও অনেকসময় ঘুম আসে না।আবার ফুটপাথে ছেঁড়া কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে দিব্বি ঘুমায়,মশার কামড় খেয়েও ঘুম ভাঙ্গে না।সেজন্যে বলা হয় সুখ বিষয়টি আপেক্ষিক যা মানুষে মানুষে বদলায়।কখনো সুখের
সংজ্ঞা এক হয় না,হতে পারে না।
এরসাথে আজকের শিরোনামের পুরোপুরি মিল নেই, তবে কিছুটা আছে। যেমন অনেক সামর্থ্যবান মানুষ সুখে থাকতে জানেই না।মানুষের চাহিদা অফুরন্ত বা অপরিসীম। বাড়ি হলে, গাড়ি চায়; গাড়ি হলে নারী চায়।আবার কোন কোন নারীর প্রয়োজন দামী গহনা।গহনা একটা হলে আরেকটা প্রয়োজন। স্বর্ণের থাকলে হীরা খোঁজে। এসব মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য এবং এটাই স্বাভাবিক। যাঁরা চাহিদার সাথে যোগান ঠিকঠাক পান,তাঁদের সমস্যা নেই। সমস্যা তাঁদের, যাঁদের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে দূরত্ব থাকে। এগুলো সামষ্টিক বা তাত্ত্বিক কথা।
একে ব্যবহারিক করতে হলে ব্যক্তিগত আলোচনা প্রয়োজন।এটি একটি ইংরেজি প্রবাদ, এর অর্থ সুখ নিজের পছন্দের বিষয়। আমি একে বলি মিলিয়ে চলার বিষয়। আমি এককালে বিচারক ছিলাম। তখন যেসব সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছি সেগুলো যদি এখন আশাকরি, তবে জীবনে সুখী হতে পারবো না।শুধু আফসোস করতে করতেই জীবন কেটে যাবে,কিন্তু আফসোস ফুরাবে না।
তারচেয়ে বরং আমি উল্টো ভাবি,বিচারক জীবনে যে চাপ ছিল সেটা এখন নেই।(চাপ বলতে কোন রাজনৈতিক চাপের কথা বলছি না,সেরকম চাপ আমার পুরো বিচারক জীবনে সামান্যই পেয়েছি)।তবে চাপ হচ্ছে ন্যায়বিচার করার।এদেশে দলিল জাল হয়,সাক্ষীরা হরহামেশাই মিথ্যা কথা বলে। যাঁদের কোর্টকে সহায়তা করার কথা তাঁরা সবসময় তা করেন না,বরং অনেকক্ষেত্রে উল্টো ঘটনা ঘটে। এছাড়া মানুষকে দন্ড দেয়া খুব কঠিন কাজ,বিশেষ করে মৃত্যুদণ্ড। এমন অনেক মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি বা দিতে হয়েছে তাতে অনেক রাত ঘুমাতে পারিনি।
এখন সেসব নেই, একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। নির্দিষ্ট
সময়ে কোর্টে যাবার চিন্তা নেই, ছুটিছাটার ঝামেলা নেই।সকালে ঘুম থেকে উঠে হেঁটে এসে পালিত পশু
পাখির যত্ন নেয়া,লাগানো গাছপালা বাগান দেখাশোনা করা।সকালের খাবার খেয়ে মাঝেমধ্যে স্কুলে যাওয়া,
দুপুরে খেয়ে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে বিকেলটা বন্ধুদের সাথে কাটানো, সন্ধ্যায় পরিবারের সাথে টিভিতে খবর দেখা। দেশের খেলা থাকলে দেখি,এরপর দ্রুত ঘুমিয়ে যাই।
রিটায়ার করার পরে ঢাকায় থাকার সুযোগ ছিল, নিদেন পক্ষে সোনাতলায়।কিন্তু আমি সেখানে না থেকে বাড়িতে থাকি। এর প্রথম ও প্রধান কারণ আমি অনেকের মতো আমার জন্মস্থান এবং এর আশেপাশের মানুষদের ভালবাসি।সবকিছুকে আপন মনে হয়। যেটা ঢাকা বা সোনাতলায় মনে হয় না, কিছুটা হলেও দূরত্ব অনুভব করি।বিশেষ করে ঢাকা শহর অনেকের পছন্দের জায়গা হলেও আমাকে সেভাবে টানে না।অবসরের পরে সুযোগ একেবারে যে আসেনি তা নয়।বরং একটা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার একটা প্রস্তাব থাকলেও তা নানা কারণে আমার খুব পছন্দ হয়নি। আসলে সেসব প্রতিষ্ঠান অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের নিতে চায় শুধু শিক্ষকতা নয়,বরং আদালতে লবিস্ট হিসেবে কাজ করতে পারবে সেজন্য।এছাড়া একটা লাইসেন্স নিয়ে উচ্চাদালতে ওকালতি করতে পারতাম। কিন্তু কেন জানি আমার প্রথম এ পেশাটাকে কখনো ভালবাসতে পারিনি। যাকে ভালবাসিনি তার সাথে কি বসবাস করা যায়?
যে অবসরভাতা পাই তাই যথেষ্ট, বাড়িতে ব্যয় তেমন নেই বললেই চলে। এখানে ত্রিশ চল্লিশ হাজার টাকা ব্যয় করে রাজার হালে থাকা যায়,ঢাকা শহরে থাকলে এ টাকায় পরিবহন ব্যয় মিটতো না।এছাড়া আমার একটা ব্যক্তিগত কার আছে, যেটাতে করে যখন খুশি যেখানে খুশি বেড়াতে যাওয়া যায়,আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ রাখা যায়।তবে স্বল্প দূরত্ব মানে এক দেড় কিলোমিটার পায়ে হেঁটে এবং দুই থেকে পাঁচ কিলোমিটার ভ্যানে চলাচল করি।এসব জায়গায় গাড়ি ব্যবহার করি না।আমার ধারণা এতে করে মানুষের সাথে যোগাযোগ ঠিক থাকে। এসব জায়গায় গাড়ি ব্যবহার করলে সেটা এলাকার মানুষের সাথে দূরত্ব তৈরি করতো।
সেদিন একটা সাক্ষাৎকারে প্রশ্নকর্তা আমার জীবনের অপূর্ণতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তাৎক্ষণিকভাবে সন্তোষজনক কোন উত্তর দিতে পারিনি। বলেছিলাম ছেলেরা কাছে থাকে না,এটা অপূর্ণতা।কিন্তু এটা তো পুরোপুরি সঠিক নয়।ওরা ওদের জীবন জীবিকার জন্য বাইরে থাকে, এতে আমাদেরও অনুমোদন আছে। তবে মাঝেমাঝে কষ্ট লাগে, ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিন্তু যখন ওদের সাথে দেখা হয়,তখন যে আনন্দ হয় তাতে এ শুণ্যতাকে অর্থহীন মনে হয় না।এছাড়াও হয়তো কিছু অপূর্ণতা বা কষ্ট আছে। কিন্তু আমি গ্লাসের অর্ধেক ভরা বলতে পছন্দ করি,অর্ধেক খালি বলতে একদম পছন্দ করি না।
সেজন্য বলা যায় আমি সুখে আছি। সুখ আমার পছন্দ, তাই সুখে আছি, নইলে অসুখী হতে চাইলে শতেক কারণ বের করা যাবে।সেজন্যই বোধহয় বলা হয়,happiness is a choice.