ঋগ্বেদ সংহিতায় অগ্নির কাছে প্রার্থনায় ‘গাভীদের খণ্ড খণ্ড করে ছেদন’ করবার উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যত্র ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে, ‘তুমি আমার জন্যে পনের-কুড়িটি বৃষ রান্না করে দাও, আমি তা খেয়ে আমার উদরের দুদিক পূর্ণ করি, আমার শরীর স্থূল করি।’ ইন্দ্রের কাছেই প্রার্থনায় আরেক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘গোহত্যাস্থানে যেমন গরুরা হত হয়, আমাদের শত্রু রাক্ষসেরা তেমনি যেন তোমার অস্ত্রের দ্বারা নিহত হয়ে পৃথিবীতে শয়ন করে।’ অগ্নির কাছে প্রার্থনায় বলদ, ষাঁড় এবং দুগ্ধহীনা গাভী বলিদানের উল্লেখ আছে। ঋগ্বেদ সংহিতার সুপ্রসিদ্ধ বিবাহসূক্তে কন্যার বিবাহ উপলক্ষ্যে সমাগত অতিথি-অভ্যাগতদের গোমাংস পরিবেশনের জন্য একাধিক গরু বলি দেবার বিধান আছে।
অর্থববেদ সংহিতায় একই বিধান আছে। তাছাড়া ঘোড়ার মাংস এবং মোষের মাংস খাবার উদাহরণ ঋগ্বেদে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। শতপথ ব্রাহ্মণে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের অনুশাসন উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে গরুর মাংস যদি নরম হয় তবে তা খাওয়া যেতে পারে। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে শুধু যে গোহত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাই নয়, কোন দেবতার কাছে কি ধরনের গরু বলি দিতে হবে তাও বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। বিষ্ণুর জন্য ছোট ষাঁড়, ইন্দ্রের জন্যে বাঁকা শিংযুক্ত বলদ, পূষনের জন্য কালো গরু এবং রুদ্রের জন্য লাল গরু বলি দেবার বিধান দেওয়া হয়েছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটি শ্লোক: কোনো ব্যক্তি যদি এমন পুত্র লাভে উচ্ছুক হন, যে পুত্র হবে প্রসিদ্ধ পণ্ডিত, সভাসমিতিতে আদৃত, যার বক্তব্য শ্রুতিসুখকর, যে সর্ববেদে পারদর্শী এবং দীর্ঘায়ু, তবে তিনি যেন বাছুর অথবা বড় বৃষের মাংসের সংগে ঘি দিয়ে ভাত রান্ন করে নিজের স্ত্রীর সংগে আহার করেন। বৃষমাংস বিরিয়ানীর মতো রান্না করে রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বৈদিক সাহিত্যের অন্তর্গত গৃহ্যসূত্রগুলিতেও গরুবলি এবং গোমাংস ভক্ষণের সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে। অধিকাংশ গৃহ্যসূত্রে ব্রাহ্মণ, আচার্য, জামাতা, রাজা, স্নাতক, গৃহস্থের প্রিয় অতিথি অথবা যে কোনো অতিথির জন্যেই মধুপর্ক অনুষ্ঠানের বিধান আছে। আর সেই অনুষ্ঠানে গোমাংস পরিবেশন করাই ছিল সাধারণ বিধান ও রীতি। এই লোকাচার এমন ব্যাপক ও বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রের বিধান অনুযায়ী বাড়িতে অতিথি এলে গরুদের বাঁচাবার জন্য ছেড়ে দেওয়া হতো যাতে অতিথিরা মনে করে যে, বাড়িতে গরু নেই। রুদ্রের উদ্দেশ্যে বৃষ বলি দেবার এবং সে বলির মাংস ভক্ষণ করবার সুস্পষ্ট এবং বিস্তারিত বিধান দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, এভাবে বৃষমাংস ভক্ষণ করলে নানাভাবে ভাগ্যোদয় হবে। বিত্ত, জমি, পবিত্রতা, পুত্র, গবাদি পশু, দীর্ঘায়ু এবং ঐশ্বর্য লাভ হবে। একই রকম বিধান আছে, আপস্তম্ভ গৃহ্যসূত্র, পারস্কর গৃহ্যসূত্র এবং হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্রতে। হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্রে গরু বলি দিয়ে সে মাংস রোস্ট করে ঘি এবং ভাতের সংগে মিশিয়ে প্রয়াত পূর্বপুরুষদের উৎসর্গ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আরো অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। তাহলে ভারতের নাগরিকগণ গরু খাওয়া বাদ দিলো কেনো? স্পষ্ট কারণ রয়েছে। অতিরিক্ত গরু ভক্ষণের ফলে ভারতে গরু অতিমাত্রায় কমে যায়। এতে দুধ উৎপাদন ও কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়। এ থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্যই গোহত্যা নিষিদ্ধ করে সেটাকে ধর্মীয় বিধান হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়। মানুষ হয়তো সাধারণ নির্দেশ মানতো না কিন্তু ধর্মীয় নির্দেশ মনে করে তারা মেনে নেয়।
পৃথিবীতে ৪৩০০টি ধর্মের মধ্যে বিস্ময়কর একটা পার্থক্য যে, একেক ধর্মে একেকটা খাওয়া নিষিদ্ধ। এখন মুসলিমরা শূকর খাওয়ার বিরুদ্ধে যে যুক্তিগুলো দেয় ঠিক একই যুক্তি দেয় হিন্দুরা গরু খাওয়ার বিরুদ্ধে। লালনের মতো আমারও প্রশ্ন? যিশু শূকর ও গরু খেতে বলেছে কিন্তু মুসলিমরা শূকর ও হিন্দুরা গরু খাওয়ার কথা শুনলে কেন আঁৎকে উঠে? কেবলই ধর্মীয় ও প্রথাগত কারণেইতো! এমন নিষিদ্ধের কারণে সাধারণ মানুষইতো আমিষ হতে বঞ্চিত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে কম মাংস খাওয়াদের অন্যতম। এসব বিধিনিষেধ না থাকলে মানুষের আমিষ খাওয়া বাড়তো এবং তারা আরেকটু সুস্থ ও সবল থাকতো। এতো অবৈজ্ঞানিক দাবি ও কর্মকাণ্ড পৃথিবীতে ধর্মীয় গুরুদের ভবিষ্যৎই অনিশ্চিত করে দিবে।