ইরানের হাতে আছে বিশ্ব অর্থনীতির ‘অদৃশ্য বোমা’। দেশটির সামরিক ও কূটনৈতিক অবস্থান যতই চাপের মুখে থাকুক না কেন, তাদের এক অদৃশ্য কিন্তু কার্যকর অস্ত্র হলো হরমুজ প্রণালী। বিশ্ব তেল বাণিজ্যের একটি অনিবার্য করিডোর হওয়ায় এটি যে কেবল ইরানের একটি ভৌগোলিক সুবিধা, তা নয়—এটি তাদের কৌশলগত অস্ত্রও বটে। বর্তমান সংকটে, ইরান হরমুজ প্রণালী আংশিক বন্ধ করলেও তারা এটি পুরোপুরি বন্ধের হুমকি দিয়েছে, যা এক অজানা আতঙ্কে ফেলেছে তেল বাজার, বিনিয়োগকারি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ জনগণকে।
হরমুজ প্রণালী হচ্ছে মাত্র ৩৯ কিলোমিটার প্রশস্ত, যার কার্যকর নৌচলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয় প্রায় ১০ কিলোমিটার। এই ক্ষুদ্র গলিপথ দিয়েই প্রতিদিন গড়ে ২০.৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পাড়ি দেয়—যা বিশ্বজুড়ে দৈনিক তেল চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ। এই একক প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে প্রতিদিনের হিসাবে বাজারে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ডলার। এক মাসে এই ক্ষতির অংক দাঁড়াতে পারে ৫২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
এই প্রেক্ষাপটে যদি সরবরাহ-চাহিদার গাণিতিক মডেল প্রয়োগ করি, তাহলে দেখা যাবে যে হরমুজ বন্ধ হলে তেলের দাম ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। কারণ বিশ্বে প্রতিদিন ১০০ মিলিয়ন ব্যারেল তেলের চাহিদা থাকলেও হঠাৎ করে যদি ২০ মিলিয়ন ব্যারেলের ঘাটতি দেখা দেয়, তাহলে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে দামে। তেলের স্বল্পমেয়াদী চাহিদা স্থিতিস্থাপকতা যেখানে -০.১, সেখানে এমন ঘাটতিতে তেলের দাম তিন গুণ বেড়ে ২৫৫ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে, যা ইতিহাসে নজিরবিহীন।
ইরান এই প্রণালীকে শুধুমাত্র একটি জলপথ হিসেবে দেখছে না। এটি তাদের একপ্রকার প্রতিরক্ষামূলক এবং আক্রমণাত্মক কৌশল। প্রয়োজনে তারা পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে হরমুজ প্রণালীকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি ও ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনাগুলো ইঙ্গিত দেয় যে হরমুজ তাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নেই ঠিকই, তবে তারা যেকোনো মুহূর্তে সেটিকে অচল করে তুলতে পারে। কারণ ইরানের পক্ষ থেকে হুমকি পেলে বিশ্বের কোন জ্বালানিবাহী জাহাজ ও পথে যাওয়ার চিন্তাও করবেনা।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, তাদের ১.২ বিলিয়ন ব্যারেল তেলের রিজার্ভ থেকে প্রয়োজনে সরবরাহ দেওয়া হবে। কিন্তু সেই রিজার্ভ দিয়ে চলা যাবে বড়জোর ১২ দিন, যদি বিশ্বব্যাপী ১০০ মিলিয়ন ব্যারেল দৈনিক চাহিদা ধরা হয়। এর পরে শুরু হবে তীব্র সংকট, মূল্যস্ফীতি, খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া এবং উৎপাদন খরচের ঊর্ধ্বগতি।
এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও দ্বিধার মধ্যে রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একদিকে যেমন হুমকি দিচ্ছেন, অন্যদিকে তেলের দাম বেড়ে গেলে তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভেঙে পড়বে। সস্তা জ্বালানির প্রতিশ্রুতি পূরণে তার নীতিনির্ধারকদের সামনে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। গ্যাসোলিনের দাম বেড়ে গেলে সাধারণ মার্কিন নাগরিকের ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে, যা নির্বাচনী বছরকে আরও চাপের মুখে ফেলবে।
অন্যদিকে ইসরায়েল এখনো পর্যন্ত ইরানের তেল অবকাঠামোতে সরাসরি হামলা চালায়নি। কারণ এটা করলে ইরান প্রতিশোধমূলকভাবে হরমুজ পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে। এর ফলে বৈশ্বিক তেল সরবরাহ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে, যার দায় ইসরায়েলের কাঁধেই বর্তাবে। এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েল চাইছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে সীমিত হামলার মধ্য দিয়ে ইরানের পরমাণু কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে, কিন্তু পুরো তেল পরিকাঠামোয় না গিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন ধরে রাখতে। তবে ইরান যে ভয়াবহ পাল্টা হামলা চালিয়েছে তাতে সামনের দিনগুলো এখন অনিশ্চয়তায় ভরা।
বিশ্লেষকদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে ইরান ইরাকের কিছু তেলক্ষেত্রে হামলা চালাতে পারে, যেখানে তারা পূর্বেও একাধিকবার ‘মিলিশিয়া গোষ্ঠীর মাধ্যমে’ আক্রমণের অভিযোগ এনেছে। এতে সরাসরি হরমুজ বন্ধ না করেও ইরান আঞ্চলিক তেল সরবরাহ কমিয়ে দিতে পারে এবং এর জন্য পশ্চিমা প্রতিক্রিয়া মৃদু হবে বলে তারা ধারণা করছে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য শঙ্কার জায়গা হচ্ছে, হরমুজে সরবরাহ বিঘ্ন ঘটলে তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব স্থানীয় পর্যায়ে জ্বালানি, পরিবহন, কৃষি ও শিল্প খাতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। সরকারের ভর্তুকি বাড়বে, বৈদেশিক মুদ্রা খরচ বৃদ্ধি পাবে এবং বাজারে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে উঠবে।
হরমুজ প্রণালীকে তাই আর শুধুমাত্র একটি মধ্যপ্রাচ্যসংলগ্ন জাহাজ চলাচলের পথ হিসেবে ভাবা যাবে না। এটি এখন এক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্নায়ু, যেটির ওপর নির্ভর করছে শিল্প, কৃষি, ভোক্তা মূল্য এবং ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য। এই জলপথ এখন একটি অদৃশ্য বোমা, যেটি ইরানের হাতে সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে।
বিশ্বনেতাদের এখন কূটনীতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক কৌশলের সমন্বয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। যুদ্ধ নয়, আলোচনার পথেই কেবল হরমুজ এবং এর প্রভাব থেকে বিশ্বকে রক্ষা করা সম্ভব।