আজ ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, সকাল ১০.৩০ টায় আন্তর্জাতিক সিডও দিবস ২০২৫ উদ্যাপন উপলক্ষে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে সিরডাপ মিলনায়তনে (চামেলী হাউজ,১৭ তোপখানা রোড, ঢাকা) ‘সংসদে নারীর কার্যকর ও ফলপ্রসূ প্রতিনিধিত্ব: সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন’ বিষয়ক গোলটেবিল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মডারেটর হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির।
সভায় সম্মানিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর প্রাক্তন সংসদ সদস্য ড. নিলোফার চৌধুরী মনি, ঐক্যন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাড. এস এম এ সবুর, জাতীয় পার্টির মহাসচিব ব্যারিষ্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী,বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-এর সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়াকার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)- এর সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ এবং সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির নেতৃবৃন্দ।
গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত সকলে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সরাসরি নির্বাচনের বিষয়ে একমত পোষণ করেন।
ধারণা পত্রে নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অন্যতম শর্ত দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তার অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা। জাতীয় সংসদে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্যের উপস্থিতি নারীসমাজের স্বার্থ ও মানবাধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখবে এবং জনগণের কাছে তাদের দায়বদ্ধতা তৈরি করতে সহায়ক হবে। স্থানীয় সরকারের সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিধানটি স্থানীয় সরকারে বহুদিন থেকে কার্যকর হয়ে আসছে। একইভাবে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচনের ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ প্রশস্ত করতে তিনি এসময় সুপারিশসমূহ তুলে ধরেন। সুপারিশগুলো হলো: জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন থাকতে হবে; জাতীয় সংসদে মোট আসন সংখ্যা ৪৫০ হবে, যেখানে ৩০০ সাধারণ আসন এবং ১৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন রাখতে হবে; পাশাপাশি ২টি সাধারণ আসন নিয়ে একটি সংরক্ষিত আসন হবে; সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়নের প্রথা বাতিল করে একটি সুনির্দিষ্টি নির্বাচনী এলাকা থেকে সংরক্ষিত নারী আসনে জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং এই ব্যবস্থাটি ২/৩ টার্মের জন্য বলবৎ থাকতে হবে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর প্রাক্তন সংসদ সদস্য ড. নিলোফার চৌধুরী মনি বলেন, ২০২৫ সালে এসেও নারীকে ভাবতে হয় সে মনোনয়ন পাবে কিনা, যা খুবই দুঃখজনক। আরপিও অনুসারে নারীর ৩৩% প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের জায়গায় রাজনৈতিক দল থেকে বাস্তবায়নের পরিবর্তে কেবল সময় ক্ষেপন করা হয়েছে। নারী তার মর্যাদা চায়। সিডও সনদ এবং সংবিধানে নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা হয়েছে, এর বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোকে তৎপর হতে হবে। নারীরা পুরুষের সাথে অন্যান্য সকল কাজ করতে পারলে রাজনীতিতেও তারা পাশাপাশি কাজ করতে পারবেন। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য প্রচলিত রাজনৈতিক পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার।
ঐক্যন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাড. এস এম এ সবুর বলেন, নারীর অধিকার নাই সম্পদে, নাই দেশ শাসনে। রাজনীতিতে তাদের ভ’মিকা প্রতিনিধিত্বমূলক নয়। সিডও সনদের ধারা ০২ ও ১৬, ১ (গ) এর উপর সংরক্ষণ তুলে স্বাক্ষর করতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। আগামীতে সকল রাজনৈতিক দলকে নারীর জন্য আসন সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবি জানান।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব ব্যারিষ্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, সংবিধানে মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে নারীর সমতার কথা বলা হলেও সেটি এখনো নানামুখী কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। আজকের সুপারিশকৃত দাবিগুলো বাস্তবায়নে অনেক দল একমত হবেনা, এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর সংগ্রহ করে মেমোরেন্ডাম করে জমা দিতে হবে। নারী জনপ্রতিনিধিদের জন্য বরাদ্দবৃদ্ধি করতে হবে; সংসদের উচ্চকক্ষে ৫০% নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-এর সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির দাবিগুলো নিয়ে আমাদের লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে। নারীদের ভোটাধিকার প্রয়োগে সচেতন করতে হবে; অনেক নারী ভোটার হতে চায়না বিশেষ করে গার্মেন্টসে যেসকল নারী কাজ করেন। এই বিষয়ে সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়াকার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় মনস্তাত্তিকভাবে প্রধান সংকট পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা ভাবনা। নারীরা পুরুষের সমান নয়- এই ভাবনা সমাজ এখনো বহন করে চলেছে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে তিনি এসময় সুপারিশ করেন রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ আসনে নারীকে মনোনয়ন দিতে হবে, নির্বাচন কমিশনকে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে নারীদের আর্থিক সহায়তা দিতে হবে; আরপিও বিধান অনুসারে তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে ৩০ বা ৩৩% নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে; রাজনীতিতে নারীর জাগরণ, প্রতিবাদের লড়াই নারীর একার নয় এখানে পুরুষদের যুক্ত হতে হবে। নারীবিদ্বেষী রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের প্রতিহত করতে ক্যাম্পেইন পরিচালনা করতে হবে।
বাসদ এর সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ বলেন, আমাদের মোট জনসংখ্যার ৫১% নারী। নারীর পদায়ন আর ক্ষমতায়ন এক নয়, সংরক্ষিত নারী আসনের দায়িত্ব কর্তব্য সুনির্দিষ্ট করতে হবে- নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়ন করতে। এই মুহূর্তে নারী প্রার্থী একজন পুরুষ প্রার্থীর সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেনা। ফলে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকা উচিত এবং এই আসনে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচন থাকা উচিত।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বান বলেন, রাজনীতি, অর্থনীতিতে ও সামাজিকভাবে নারীর অংশগ্রহণ প্রান্তিক। সংবিধানে , সিডও সনদে নারীর সমতার কথা বলা হচ্ছে, এটি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ থাকবেই। সাধারণ আসনের নির্বাচনে নারীর প্রার্থীতা থাকবে তার বাইরে সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন থাকবে। নারীর জন্য কনষ্টিটিয়েন্সি বিল্ড আপ করতে হবে।
আলোচনা শেষে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সংগঠনের প্রতিনিধিদের মধ্যে মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের দিলীপ সরকার;মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রাক্তন কর্মকর্তা নাজরানা হক হীরা, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের পরিচালক শাহনাজ সুমী; ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের লিপিকা তাপসী, দলিত নারীগোষ্ঠীর তামান্না সিং বড়াইক এবং ব্র্যাকের শ্বাশতী বিপ্লব এবং নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিনিধি মাহিন সুলতানা ।
তারা বলেন, সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সরাসরি নির্বাচনের বিষয়ে সকলে একমত, কাজেই আমাদের একসাথেই আওয়াজ তুলতে হবে, নারীদের ৩৩% মনোয়ন ও প্রত্যক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে নারী সংগঠনগুলোকে আওয়াজ তুলতে হবে; নারী আন্দোলনের দাবিগুলো রাজনৈতিক ইশতেহারে থাকতে হবে, রাজনীতির পরিবেশ নারীবান্ধব হতে হবে; নারী বিদ্বেষীপ্রচার-প্রচারণা বন্ধ করতে হবে; নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধিকে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে; অধ্যাদেশ পাশের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে ২০% নারীকে যুক্ত করতে বাধ্য করতে হবে; পালন না করলে অর্থদন্ডের মত শাস্তির বিধান থাকতে হবে। সংরক্ষিত নারী আসনে প্রতিবন্ধী ও দলিত শ্রেণীর প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করতে হবে।
মডারেটরের বক্তব্যে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, সিডও সনদের মূলকথা বৈষম্যহীনতা, প্রকৃত সমতা ও দায়বদ্ধতা। নারীর জন্য আসন সংখ্যা বৃদ্ধির দাবী অনির্দিষ্টকালের জন্য নয়, ২/৩ টার্মের জন্য হতে হবে। তিনি এসময় বলেন, নারীদের নির্বাচনী এলাকার জন্য প্রস্তুত করা পর্যন্ত এই আসন বৃদ্ধির কোটাপদ্ধতি থাকতে হবে। সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন দিতে হবে। সিডও সনদের ৭ নম্বর ধারাতে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন সিডও সনদ বাস্তবায়নের দায় সরকারের জন্য সবসময় থাকছে। আজকের সভা থেকে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমরা তার স্বাধীনতা দেখতে চাই, অগ্রগতি দেখতে চাই। নারী আন্দোলন শুধু নারীরা করলেও সমগ্র সমাজ এই আন্দোলনের ফল ভোগ করে। আমাদের যাবি যতই যৌক্তিক হোক তা বাস্তবায়নে নানা বাধা আছে, সীমাবদ্ধতা আছে। নারীর মধ্যে পিতৃতান্ত্রিকতা বিরাজ করে, নারী আন্দোলনের সংকট আছে, নুতন সংকট হচ্ছে নারী-বিদ্বেষী মনোভাব , এটি নারীকে পশ্চাদমুখী করার জন্য হচ্ছে। সবচেয়ে বড় সংকট হলো প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি চর্চা বন্ধ না হওয়া। একটা বিদ্বেষ ও নৈরাজ্যের মধ্যে সমাজ চলছে। নারী আন্দোলনের শক্তিকে আরো সংহত করতে হবে, অর্ন্তভূক্তিমূলক হতে হবে, বহুত্ববাদের কথা বলে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে বাদ দিচ্ছি কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। সর্বোপরি নারী আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান তিনি।
উক্ত গোলটেবিল আলোচনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবন্দ, সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সদস্য সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রীবৃন্দ, সম্পাদকমন্ডলী, কর্মকর্তাগণ এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অ্যাডভোকেসি ও নেটওয়ার্কিং পরিচালক জনা গোস্বামী।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট