প্রতিটি সমাজেই কিছু না কিছু নৈতিকতা থাকে। অনেকেই ভাবে ধর্মের ভিতরে থাকা নেতিকতা অলৌকিক। বাস্তবিক ধর্মের মধ্যে ওইসব নৈতিকতা ঢুকেছে ওই সমাজ থেকেই। কখনো কখনো আপগ্রেড হয়েছে কিছু বিষয়। ধর্মের রিচুয়ালগুলোও ঢুকেছে সাধারণত সমাজে আগে থেকে বিদ্যমান অন্য ধর্মের রিচুয়াল থেকেই। এখানেও আপড্রেড আাছে। যেমন মুসলিমদের হজ্ব, নামাজ, রোজা ইত্যাদি নতুন ব্যবস্থা নয়। এগুলো আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল ইহুদি ধর্মে। হজ্বটা অন্য ধর্মের তীর্থের মতোই। ইসলাম পূর্ব সময়ে মক্কার ভিতরে ৩৬০টি মূর্তি ছিল। মূর্তি উপাসকরা সেই দেব-দেবী ভরা মক্কা শরিফে যেতেন হজ্ব করতে। সে সময়ে হজ্বকে কেন্দ্র করেই কুরাইশরা রমরমা বাণিজ্য করতো। ইসলাম আসার পরেও হজ্ব চালু থাকে। আজকের যুগে এসে আমরা বুঝতে পারি— এই সময়ের সাথে সামঞ্জস্য নয় এমন অনেক বিষয়ও ধর্মে আঁকড়ে ধরে আছে। যেমন মুসলিমদের বিবি তালাক ও বহুবিবাহ প্রথা, নারীদের সম্পত্তির অধিকারসহ নারীদের সম্পর্কিত ভাবনা। ফলে হাজার বছর আগের ধর্ম ওই সমাজের নৈতিকতা বা সংস্কৃতি ধারণ করলেও আজ তা ওই ধর্মের জন্য দায় হয়ে উঠেছে। এ কারণেই এখন সভ্য দুনিয়ার সামাজিক বন্ধনের প্রধান উপাদানও আর ধর্ম নয়। বাংলাদেশে পীরকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠী থাকলেও তা সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করতে— ভিত্তি হিসেবে কাজ করেনি। একই সমাজে বিভিন্ন পীরের মুরিদ বাস করে। সমাজের নিম্নতম পর্যায়ে কিছু ক্ষেত্রে বন্ধন দেখি। যেমন ঋষি সম্প্রদায়ের মানুষ কালিপূজা কেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ থাকে। তবে তারা সংখ্যালঘু না হলে এমনটা থাকতো কিনা সন্দেহ আছে। এক সময় ধর্মকেন্দ্রিক দলবদ্ধতা তৈরি হতো। এখন এক সমাজেই পেশার বৈচিত্র্য রয়েছে। কৃষির পরিবর্তে বেশির ভাগ মানুষ ভিন্ন ধরনের চাকরি বা ব্যবসায় জড়িত রয়েছে। ফলে দলবদ্ধ থাকার দরকারও কমে এসেছে।
অনেকেই বলেন, ‘ধর্মে এতো নৈতিকতা এলো কোথা থেকে? এগুলো অবশ্যই স্রষ্টা পাঠিয়েছেন মানুষকে নৈতিকতার মধ্যে থাকতে।’ ধর্মের নৈতিকতা বলতে আমরা দেখি, সত্য বলা, প্রতারণা না করা, অন্যের সম্পদ ছিনিয়ে না নেয়া, বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব পালন করা, দরিদ্রদের দান করা ইত্যাদি। এসব নৈতিকতা কি যেসকল সমাজে কোন ঈশ্বরকেন্দ্রিক ধর্ম নেই সেখানে নেই? বৌদ্ধ ধর্মে কি মিথ্যা বলা বা দরিদ্রদের দান করার বিরুদ্ধে বলা হয়েছে? বৌদ্ধ ধর্মে কি প্রতারণা, অন্যের সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া বা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি মন্দ আচরণের কথা বলেছে? কিংবা চীনের ধর্মহীন মানুষগণ কি এসব সাধারণ নৈতিকতার বাইরে থাকে? এসব সাধারণ নৈতিকতার জন্য কোন সমাজের মানুষই ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল নন। বরং ঈশ্বরের নির্দেশে মানুষ এমন অনেক কাজ করেছে যা আজ নৈতিক নয়। যেমন ইসলামের ৪ বিবাহ, তিন তালাক, দাসীকে ভোগ করা, দাসবৃত্তি, জিজিয়া কর, গণিমতের মাল, জিহাদ ইত্যাদি সভ্য জগতে নৈতিক নয়। এগুলোকে ওই সময়েও সাধারণ মানুষের জন্য ভাল কিছু ছিল না। যেমন গণিমতের মাল বলে যাদের কাছ থেকে সম্পদ বা নারীকে ছিনিয়ে এনে ভোগ করা হতো তাদের কাছে এগুলো ছিল অমানবিক। জিজিয়া কর কোন বিধর্মীর জন্য কল্যাণকর ছিল না। দাস-দাসীদের কাছে অমন নৈতিকতা ছিল বর্বরতার সামীল। নারীর জন্য তিন তালাক বা তিন সতীনের ঘর করা নৈতিক মনে হতো না। তবুও তা ধর্মগ্রন্থ নৈতিক হিসেবে বলায়, প্রভাবশালী মানুষ বাড়তি সুবিধা নিতো। আজ মুসলিম সমাজেও ওই আইনগুলো কার্যকর নেই। ধর্মে থাকলেও আমরা ওই ধর্মীয় আইনগুলোকে নৈতিক বলতে পারি না।
হিন্দুদের বর্ণপ্রথা বা সতীদাহপ্রথা কি নৈতিক? কোনভাবেই কোন সভ্য মানুষ এগুলোকে নৈতিক বলবেন না। সতীদাহকে আজ কোন হিন্দুই নৈতিক বলবেন না। এমনকি বর্ণপ্রথাকেও শূদ্র-বৈশ্যসহ বহু উচ্চ বর্ণের হিন্দুও মন্দ বিধান বলেই মনে করেন। এছাড়া ধর্মগুলো নারীর প্রতি যে অবমাননাকর আইন/বিধান তৈরি করে রেখেছে তাও নৈতিক নয়। নারী কোন অশুভ বা পাপের কিছু নয়। তারা পুরুষের মতোই মেধাসম্পন্ন এবং কেবল জননাঙ্গের পার্থক্য থাকায় শারীরিক শক্তিতে পিছিয়ে রয়েছে। আজকের দুনিয়া চলছে মেধা শক্তিতে। সেই শক্তিতে বলিয়ান নারীরা সভ্য দুনিয়ায় দাপটের সাথেই কাজ করছে। অথচ পশ্চাৎপদ দেশগুলো আজও ধর্মের কথিত নৈতিকতার দোহাই দিয়ে নারীদের পিছিয়ে রাখতে চাচ্ছে।
আজকের সভ্য দুনিয়ার আইন ও চেতনা অনেক বেশি মাত্রায় নৈতিক। আধুনিক আইনগুলো মানুষকে সম্মানের সাথে অধিকার নিয়ে বাঁচার সুযোগ করে দিচ্ছে। এগুলোকেই আমরা নৈতিক বলবো। আজ উল্টো প্রশ্নই করতে হয় যে, ধর্মগ্রন্থগুলোতে অমন বর্বর আইন কে ঢুকালো? কেন ঈশ্বর সাধারণ মানুষের প্রতি অতটা অমানবিক ছিলেন। কেন জিজিয়া কর বা দাসী ভোগ চাপিয়ে দিতে পারেন? কেন পুরুষকে তিনি চারটি বিয়ে বা তিন তালাকের সুযোগ দিলেন? কেন নারীদের জন্য এতো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলেন? কেন নারীদের এতো বঞ্চনার মধ্যে রাখলেন? ব্রাহ্মণদের অতো সুবিধা দিলেন? নারীদের স্বামীর চিতায় জ্যান্ত উঠিয়ে দিতে চাইলেন? ধর্ম গ্রন্থে যে গ্রহণযোগ্য নৈতিকতা রয়েছে তা সর্বত্রই রয়েছে কিন্তু নৈতিকতা বলে আরো অনেক আইন চালিয়ে দেয়া হয়েছে তা নৈতিক নয়। এ নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব কে দিবে?