বিকেল সাড়ে ৪টা। প্রায় ফাঁকা সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে লঞ্চের হুইসল। সন্ধ্যার পর ঢাকা সদরঘাট থেকে দক্ষিণাঞ্চলের উদ্দেশে একে একে ছেড়ে যাবে অন্তত ৬০টি লঞ্চ। স্বাভাবিকভাবে দুপুর থেকেই লঞ্চ টার্মিনালে যাত্রীর আনাগোনা শুরু হতে থাকে। কিন্তু গতকাল রবিবার দেখা গেল, বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে তবু ঘাটে সেভাবে যাত্রীর দেখা নেই।
প্রতিবছরই ঈদ মানেই সদরঘাটে লঞ্চে উপচে পড়া যাত্রীর ভিড়। বারবার মাইকিং করেও লঞ্চ থেকে যাত্রী নামানো যায় না। গত ঈদেও যাত্রীর চাপে নির্ধারিত সময়ের আগে ঘাট ছেড়ে যেতে হয়েছে অনেক লঞ্চকে। কিন্তু এবার পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সদরঘাট থেকে দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চের চিত্র যেন বদলে যাচ্ছে। উপচে পড়া ভিড় আর যাত্রীবোঝাই লঞ্চের বদলে এবার হবে স্বস্তির যাত্রা। এমনটাই মনে করছেন যাত্রী ও লঞ্চের মালিক-শ্রমিকরা।
এবার পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি পথের যাত্রীদের অনেকেই সড়কপথে গন্তব্যে যাবে। তাই এই নৌপথের লঞ্চে যাত্রী তুলনামূলক কম হবে। তবে ভোলা, চাঁদপুর, লালমোহন, বসিরহাট, কালাইয়া ও রাঙ্গাবালীগামী যাত্রী স্বাভাবিক থাকবে।
লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘এবার যাত্রী অনেক কমে যাবে। কী পরিমাণে কমবে সেটা এখনই অনুমান করা যাচ্ছে না। তবে ঈদ যাত্রার প্রস্তুতিতে কোনো কমতি রাখা হচ্ছে না। আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে ভাড়া কমাব না। এমনিতেই যাত্রী কম হবে। তার ওপর ভাড়া কমালে লঞ্চ লোকসানে চালাতে হবে। ’
লঞ্চ মালিক সমিতি সূত্র বলছে, ঢাকা থেকে প্রতিদিন ৪২টি নৌ রুটে লঞ্চ চলাচল করে। স্বাভাবিক সময়ে গড়ে প্রতিদিন ৭৫ থেকে ৮০টি লঞ্চে যাত্রী পরিবহন করা হয়। এতে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার যাত্রী পরিবহন করা হয়ে থাকে। যদিও বর্তমানে এই সংখ্যা কমে এসেছে পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজারে।
গত ঈদে এমন সময়ে গড়ে প্রতিদিন ১২০টি লঞ্চ চলাচল করেছে। এতে অন্তত দেড় লাখ যাত্রী প্রতিদিন ঢাকার সদরঘাট ছাড়ে। তবে এবার যাত্রীর সংখ্যা কত নামবে, সেটা অনুমান করা যাচ্ছে না।
ঢাকা নদীবন্দর সূত্র বলছে, এবার যাত্রী অনেক কম। এত কম যে এর আগে ঈদের সময় কখনো এমনটা ঘটেনি। তবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) সব ধরনের নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। এবার নৌপথে ঢাকা থেকে যাত্রীদের চলাচল স্বস্তিদায়ক হবে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সপ্তাহ না পেরোতেই ঢাকা-বরিশাল নৌপথে লঞ্চের যাত্রী কমে এসেছে। এতে নৌযানের সংখ্যা কমানো হয়েছে, কমেছে ভাড়াও। প্রতিদিন ঢাকা থেকে বরিশালের পথে সাতটি লঞ্চ ছেড়ে যায়। ঠিক একইভাবে বরিশাল থেকে ঢাকার পথে আসে সাতটি লঞ্চ। কিন্তু গত ৩০ জুন বরিশাল থেকে পাঁচটি লঞ্চ এলেও ঢাকা থেকে ছেড়েছে চারটি। আর ১ জুলাই বরিশাল থেকে ছেড়েছে চারটি লঞ্চ।
পরিস্থিতি আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছেন মালিকরা। এরই অংশ হিসেবে গত এক সপ্তাহে ডেকের ভাড়া প্রায় অর্ধেক করা হয়েছে। একইভাবে প্রথম শ্রেণির কেবিনে কমেছে ৫০০ টাকা আর দ্বিতীয় শ্রেণির সোফার ভাড়া ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে কমানো হয়েছে গত কয়েক দিনে। ভাড়া কমিয়েও যাত্রী মিলছে না লঞ্চে। প্রতিদিন গড়ে কম করে হলেও ৫০ শতাংশ যাত্রী নৌপথ থেকে মুখ ফিরিয়েছে। তারা পদ্মা সেতু হয়ে বাসে যাতায়াত করছে।
সুন্দরবন-১০ লঞ্চের সুপারভাইজার মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘বরিশাল থেকে গত শুক্রবার রাতে সুন্দরবন-১০ লঞ্চ ছেড়ে যায়। শনিবার সকালে ঢাকার সদরঘাটে পৌঁছে। এরপর বিক্রীত টিকিট হিসাব করে দেখা যায়, যাত্রী ছিল ৩৪৭ জন। এ ছাড়া এক-তৃতীয়াংশ কেবিন খালি ছিল। সব মিলিয়ে বলা যায়, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অর্ধেক যাত্রী ছিল। ’
ঢাকা থেকে ভোলার পথের যাত্রী কিছুটা কমলেও প্রভাব ফেলার মতো অবস্থা তৈরি হয়নি। ভোলা থেকে কিছু মানুষ পদ্মা সেতু দেখার জন্য সড়কপথে এলেও ভোলার দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলার ঘাটগুলোতে ঢাকামুখী যাত্রীর সংখ্যা আগের মতোই আছে। তবে ঈদে যাত্রীর চাপ বাড়বে বলে মনে করছেন লঞ্চ মালিকরা।
বিআইডাব্লিউটিএ ভোলা নদীবন্দরের উপপরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে ভোলার বিভিন্ন লঞ্চঘাটে যাত্রী কিছুটা কমেছে। তবে সেটা উল্লেখযোগ্য নয়। কারণ ভোলা থেকে ঢাকায় যাওয়ার জন্য সড়কপথের চেয়ে লঞ্চ অনেকটা সহজ ও সাশ্রয়ী।
বরগুনা থেকে প্রতিদিন দুটি লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। বরগুনা নদীবন্দর থেকে প্রতিদিন বিকেল ৪টায় একটি এবং আমতলী লঞ্চঘাট থেকে ৪টায় একটি লঞ্চ যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যায়। বরগুনার লঞ্চঘাট থেকে প্রতিদিন দুটি লঞ্চে ৪০০ যাত্রী যাতায়াত করে। আগে এই দুটি ঘাটে লঞ্চগুলো ৫০০ যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যেত। পদ্মা সেতু ও ঈদ সামনে রেখে আগের চেয়ে লঞ্চগুলোতে যাত্রী কমে গেছে।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট