দুইশত বছর আগের কথা ভাবলেও দেখি বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ রয়েছেন— যারা বিজ্ঞান ও সমাজ সম্পর্কে খুবই অজ্ঞ। তাদের কাছে মানবতা অর্থহীন, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যতা ধারণাতীত। নিউটনের গতির সূত্রসমূহ কত সহজ ও সাদামাটা। মাত্র সাড়ে তিনশ বছর আগেও মানুষ ভাবতে পারেনি এমন সহজ সত্য। তার কিছুকাল আগে মানুষ জানতো পৃথিবী স্থির এবং গ্রহ-নক্ষত্র সবই চলমান। স্থির কাঠামো বলে কিছু নেই নিউটনের মতো বিজ্ঞানী কেন বুঝলেন না? আরো দুশ বছরের বেশি সময় লেগে গেল বিষয়টি উপলব্ধি করতে। আজও কি আমরা সাধারণ মানুষ আপেক্ষিক তত্ত্ব বুঝি? শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ সমস্ত পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে একই। এ কথার মানে কি? শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কি.মি.। একই স্থান থেকে যদি একই সময়ে আলো এবং কোন ব্যক্তি যাত্রা শুরু করে তবে ওই ব্যক্তির নিকট আলোর বেগ কত মনে হবে? বিস্ময়কর যে, ওই ব্যক্তি যত বেগেই ছুটুক আলো তার থেকে ৩ লক্ষ কি.মি. বেগে দূরে চলে যাবে। সক্রেটিসকে যেসব কারণে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় তার একটি হল— সূর্য ও চন্দ্রকে দেবতা হিসেবে না মানা! এখনো বহু মানুষ সূর্যকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করে৷
একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হাজার হাজার বছরের বিজ্ঞানকে নিজের মধ্যে ধারণ করে। তার কাছে অনেক কিছুই পরিষ্কার। সে সহজেই বুঝতে পারে ধর্ম কি? কোথা থেকে, কেন ও কিভাবে আসলো? সে বুঝে পানি পড়া ও ঝাড়ফুঁকে কেন কোন উপকারিতা নেই। পাথরে ভাগ্য ফিরে না। অলৌকিক কোন কিছু পৃথিবীতে ঘটেনি, ঘটে না। বিশ্ব চলে পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনে। সে বুঝে আত্মা-পরমাত্মা বলে কিছু নেই। এসব বুঝতে বুঝতে সে বুঝে ফেলে সমাজকে, ধর্মান্ধতাকে, পীর-ফকিরকে। সে বুঝে ফেলে ধর্মগ্রন্থ, নবী-রসুল, অবতার-দেবতা। সে জেনে যায়— জীবজগতের বিবর্তন ও জীবন সংগ্রাম। সবকিছুই স্বচ্ছ হয়ে উঠে। আরো যা কিছু জানা যায়নি মাহাবিশ্ব সম্পর্কে, সৃষ্টি সম্পর্কে তা জানতে-বুঝতে চায় বিজ্ঞানের চোখ দিয়েই। জ্ঞানে ও কর্মে অগ্রসর এই প্রগতিশীল মুক্তচিন্তার মানুষেরা অনেক ক্ষেত্রেই অবাক হয়, হায়! এতো স্বচ্ছ ও পরিষ্কার বিষয়গুলো কেন সবাই বুঝে না! কেন ভণ্ডদের প্রতারণাগুলো সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না?
নিজের ভিতরে হাজার হাজার বছর ধরে তিল তিল করে আবিস্কার করা বিজ্ঞানগুলো ধারণ করেই আপনি অগ্রসর মানুষ হয়েছেন, আলোকিত হয়েছেন। যারা অবিকশিত থেকে এসবের সন্ধান পাননি, এখনো অন্ধকারে রয়েছেন অন্ধ বিশ্বাসী হিসেবে তারা কি করে এতোসব বুঝবেন? দেশে এখনো একটি গুণ বা ভাগ না পারা মানুষের সংখ্যা কম নয়। বিজ্ঞান ও সমাজকে বুঝতে পারা মানুষ খুবই নগণ্য। সেই নগণ্য মানুষেরাও চুপচাপ থাকে ভয়ে ও আতঙ্কে। সংখ্যাগরিষ্ঠ অজ্ঞ মানুষ যদি ঝাপিয়ে পড়ে, খুন করে, ভুল বুঝে? রাজনীতির লোকদের আরো বেশি ভয়। তারা ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ অজ্ঞ মানুষদের খুশি রাখতে হবে, তাদের ভুল ধারণার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে, তাদের ভুল ধারণাকে রক্ষা করে। সংকট আরো বেড়ে যায় এবং বিপুল সংখ্যক মানুষের অগ্রগতি থেমে থাকে। পথ একটাই সমাজের অগ্রসর প্রগতিশীল মানুষদের সক্রিয় ভূমিকা রাখা। তাহলেই সমাজ বদলাবে। পশ্চাৎপদদের সাথে আপোস করে থাকলে সমাজ স্থবির হয়ে পাপোস হয়ে থাকবে৷
ইউরোপে রেনেসাঁ এমনিতেই আসেনি। সেখানে শিল্পী-সাহিত্যিকদের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। সেই ধাক্কায় ইতালিতে শুরু হওয়া জাগরণ ছড়িয়ে পড়ে ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল, হল্যান্ড, ইংল্যান্ডসহ সমগ্র ইউরোপে। আমাদের প্রধান লেখকদের অধিকাংশই উচ্ছিষ্টভোগে ব্যস্ত। তারা দালালে পরিণত হয়েছে। তারা জাগরণের জ্বালানি না হয়ে প্রতিরোধক হয়ে উঠেছে। এদের দলিত করেই জাগরণ তৈরি করতে হবে। সেই জাগরণের আলোতেই আলোকিত করতে পারলে, সাধারণ মানুষও ভণ্ডদের বুঝতে পারবে।
সক্রেটিস, হাইপেশিয়া, ব্রুনো, হুমায়ুন আজাদ সাধারণে আলো পৌঁছাতে জীবন দিয়েছেন৷ আপোস করে থাকলে পৃথিবী আজকের অবস্থায় পৌঁছাতো না৷ আলো পৌঁছাতে আমাদেরও ভূমিকা রাখতে হবে৷