গায়ে কাটা দেওয়ার মতোই যাদুকরি তার রূপ। অপরূপ স্বচ্ছ পানিতে নিজের মুখ দেখে দূরের আকাশ। আকাশের সব নীল আর পাহাড়ের সবুজ যেন মিশে আছে এই নদীর স্বচ্ছ জলে। সূর্যের গতির সঙ্গে কখনো নীলাভ, কখনো সবুজ রং খেলা করে পাহাড়ি এই নদীতে। রঙের জাদুকরী এই খেলার জন্যই নদীর নাম জাদুকাটা।তার প্রতিবিম্ব বুকে ধারণ করে যাদুকাটা কখনো রূপালী, কখনো অমোঘ নীল আর কখনো গম্ভীর ধূসর।
এ নদীকে ঘিরে রয়েছে ৭৫০ বছরের প্রাচীন ইতিহাস। নাগরানীর প্রেমে পড়ে নাগকুমার যেই বিস্তৃত বাণ প্রাচীর তৈরি করেন সেই প্রাচীরই আজকের জাদুকাটা নদী। ইচ্ছে পূরণের উদ্দেশ্যে প্রতি বছর দোল পূর্ণিমার ত্রয়োদশীতে লক্ষাধিক হিন্দু ধর্মালম্বীদের সমাগম ঘটে যাদুকাটায়। নির্দিষ্ট তিথিতে গোসল করে নিজেকে কলুষমুক্ত মনে করেন তারা। টাংগুয়ার হাওর থেকে কাছে পাহাড়ের কোলঘেষে ছুটে চলা ছোট্ট নদী যাদুকাটা। একদিকে নজরুলের ভাষায় আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই, অন্যদিকে হাওর। মসৃন বালির উপর দিয়ে কুলকুলু বয়ে গেছে পাহাড়ী যাদুকাটা।
যাদুকাটা ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় হতে উৎপত্তি হয়ে সুনামগঞ্জ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ৩২ কিলোমিটার লম্বা, প্রস্থ ১০০ মিটার, গড় গভীরতা ৮ মিটারের মতো এবং অববাহিকায় গড়ে উঠা ভূমির আয়তন ১২৫ বর্গকিলোমিটার। টাঙ্গুয়ার হাওরের স্বচ্ছ জলের প্রবাহ তো অনেকটাই জাদুকাটা নদীর ধারা। এই নদীতে সারা বছরই কম বেশী পানিপ্রবাহ থাকে। তবে সাধারণত স্বল্প বন্যায় নদীর দুকুল প্লাবিত হয়। কারণ এটি খুব গভীর নয়। হেমন্তে কিছুটা শুকিয়ে যাওয়া নদীর বিশাল এলাকাজুড়ে ধুধু বালুচর এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। মনোহর রুপের পাহাড়ী যাদুকাটা দেশের অন্যতম সুন্দরম নদী। বৈচিত্রময় নাম কখনো কখনো রক্তি নদীও বলা হয়। কথিত আছে এই নদীর জলে তিনবার ডুব দিলে যাদুকরের বাণ টোনা সব অকার্যকর। কামরূপ কামাখ্যার মায়ামোহন সন্ন্যাসীরা এই নদীর জল ছিটিয়ে সম্মোহনমুক্ত করেন।
ভরা বর্ষায় নদীর উন্মত্ততায় ভীত হয় ওঠে তীরবর্তী মানুষ। তবে শীত বা হেমন্তে নদী শান্ত রূপ ধারণ করে। এ সময় সকাল, দুপুর বা সন্ধ্যায় নদী ও এর আশপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য প্রকৃতিতে যোগ করে এক ভিন্ন মাত্রা, ছড়ায় মুগ্ধতার আবেশ। এই জাদুকাটা নদী ও এর আশপাশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং সেই সঙ্গে লাউড়ের গড়ে শাহ-আরেফিন রহঃ মাজার ও সংলগ্ন নো-ম্যান্সল্যান্ড পর্যটকদের দারুণভাবে আকর্ষণ করে।
বিশাল জাদুকাটার বুক এখন বালিতে ভরা। হেমন্তে লাউড়েরগড় থেকে নদীর বুক ভরা বালির ঢিবির ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে বা মোটরসাইকেলে করে যেতে যেতে মাঝে মাঝে মনে হয় কোনো মরুর দেশে এসে পড়েছি। পশ্চিমে নদীর অপর তীর কয়েক কিলোমিটার দূরে। সেখানে অনেক শ্রমিক নদীর তলদেশ থেকে পাথর ও বালু আহরণ করে নৌকায় তুলছে। সে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। উত্তরে বিশাল খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় আর পাহাড়ের গায়ে সাদা সাদা বাড়ি এক অপূর্ব দৃশ্যপট । সেখানে দুটি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ভারতের গুমাঘাটের সমতল থেকে জাদুকাটা নদী বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করেছে। জাদুকাটা নদীর পানি এতটাই স্বচ্ছ যে তলদেশের নুড়ি আর বালি দেখা যায় স্পষ্ট। এই দেখার কোন শেষ নেই যেন অনন্তকালের ধ্যানে মগ্ন হয়ে আছেন কোন ঋষি। ঋষির ধ্যান ভাঙ্গবে না কেননা তাঁর এই ধ্যান এক অনন্তর মোহাবিষ্ট নদীর রূপে চলে গেছে সুরমা নদীর দিকে।