আজ শবে বরাত, বাংলাদেশের অনেক পরিবারে শবে বরাত উপলক্ষে বয়ে যায় এক উৎসবের আমেজ, দিনটি উপলক্ষে সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়, সারাদিন চলে অনেক ঘরে রুটি ও নানা রকম হালুয়া বানানো এবং সেগুলো গরীবদের মাঝে ও পাড়া প্রতিবেশীর বাসায় বিতরণ। পিছিয়ে নেই এ গল্পের নায়ক বালার পরিবারও। শৈল ( বালার স্ত্রী) সারাদিন অনেক খেটেছে, রোজা রেখেছে, এখন গোসল করে পানির প্রতি ফোঁটায় গুণাহ মাফ চেয়ে নামাজ পড়ছে। বালা বাজার থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে এনে দিয়েছে, নামাজ পড়েছে, তবে শৈলর মতো গোসল, নফল রোজা সে করেনি, তার পরিবারে রোজা ছেলেরা তেমন রাখে না, বাবাও কখনও করেনি, মা সবসময় করতেন, তার দেখাদেখি বোনেরা, বিয়ের পর শৈলও মনের অনিচ্ছায় হলেও পারিবারিক শান্তির জন্য তার মায়ের আদলে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে।পারিবারিক কলহ এড়াতে বালা শৈলর পাশে দাঁড়াতে পারেনি, কেঁদেছে দিনের পর দিন যখন রুমে এসেছে, বালার খারাপ লেগেছে, কিন্তু মায়ের খুশীর জন্য শৈলর উপর মায়ের এ খবরদারিতে সে বাঁধা দিতে পারেনি, তাদের ঘরে ধর্মের বাড়াবাড়ি মেয়েদের উপর দিয়েই যায়, মায়ের কথা – ঘরের বৌ ঝি ইবাদত বন্দেগী না করলে রহমতের ফেরেশ্তা আসবে না। একবার দুর্বলভাবে বলেছিল মাকে – মা ফেরেশ্তা কি ছেলেদের ইবাদত দেখে না? কাজ হয়নি, বালা এক ছেলে হওয়ায় মায়ের অনেক আহ্লাদে বড় হওয়া – মাকে কষ্ট দিতে পারে না- তাই সব কষ্টের শিকার হয় বেচারী শৈল- এতিম মেয়ে যাবে কোথায়? যদিও তাদের প্রেমের বিয়ে। আজও মনে পরে বালার?
ট্রেনে ফেনী রেলওয়ে স্টেশন থেকে ঢাকাত যাবে বালা। ট্রেন আজ অনেক লেট। কত মানুষ রেলওয়ে স্টেশনে ঘুরছে, কেউ যাত্রী, কেউ রেলওয়ে কর্মচারী, কেউ কুলি, কেউ ফেরিওয়ালা, কেউ ভিক্ষুক, কয়েকটি মোবাইল চা পানের দোকান, চানাচুর,মুড়ির ও আচারের ঠেলাগাড়ী নিয়ে ফেরী, ছোট্ট বুক স্টল যেখানে বইয়ের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সবকিছুই আছে যেমনঃ লোশন, শ্যাম্পু, ব্যান্ডেজ, ব্লেড, সাবান, পানি ইত্যাদি, আছে ডাবের পানির বিক্রেতা, মেয়েদের চুড়ির ও অন্যান্য প্রসাধনীর ফেরী। এতসবের মাঝে স্টেশনের একটা পিলারে হেলান দিয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে দেখলো তিনজন ভিক্ষুককে। যে কারণে তারা নজর কাড়লো, তারা সবাই অন্ধ নয়, গায়ের কাপড় চোপড় ময়লা পুরনো তবে ছেঁড়া নয়, অন্ধ মহিলা সামনে, তার কাঁধে হাত দিয়ে সুস্হ বয়স্ক পুরুষ, তার কাঁধে হাত দিয়ে বয়স্ক মহিলা, সামনের অন্ধ মহিলার বয়স তারই কাছাকাছি মানে ২৭/২৮ হবে।ভদ্রমহিলা গান তাকে তার দিকে তাকাতে বাধ্য করলোঃ সে গাইছিলোঃ হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ, এজীবন জ্বইলা পুইরা শেষ তো হইলো না…..
মনে হলো একজন অন্ধ মানুষ এতো সুন্দর গায়, সত্যিই আমার সোনার বাংলার রেলওয়ে স্টেশনে কতো পথশিল্পী ঘুরে বেড়ায়। কাছে যেয়ে কিছু টাকা তাকে দান করে জানতে চাইলোঃ শিখেছেন কোথাও গান?
মেয়েটি লজ্জা পেয়ে বললোঃ ভাইজান যে কি কয়? আমরারে কে শিকাইবো গান, বাবায় যখন কাম করতে ফারতো তখন একটা টিভি কিনছিলো, ট্রানজিস্টর কিনছিলো, আমি শুইন্যা শুইন্য শিখছি। তখন কি জানতাম, এই গান গাইয়াই আমারে রাস্তায় বিক্কা করন লাগবো!
মহিলা ভদ্র, নম্র, জানতে ইচ্ছে করলো তার সম্বন্ধে কিন্তু ট্রেন এসে যাওয়ায় সে বললো, আরেকদিন শুনবো আপনার গল্প।ট্রেনে দরজায় এক পা আর এক পা বগিতে দিয়ে ট্রেনে উঠতে যাবে তখন একটি মেয়ে কন্ঠ চিৎকার দিয়ে বলছেঃ ছাড়ুন আমার চুল, আহ্ লাগছে।
বালা এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখে তার প্যান্টের পেছনের পকেটের সাইড বোতামে মেয়েটির চুল আঁটকে গেছে ভীড় ঠেলে হুড়োহুড়ি করে উঠার সময়, মেয়েটি আপ্রান চেষ্টা করছে চুল ছাড়ানোর। বালা নড়লেই চুলে টান লেগে যাচ্ছে, করে কি সে? তার উপর এক হাতে ট্রেনের দরজা ধরা আরেক হাতে ব্যাগ? মেয়েটির কলার স্বর বড় মিস্টি, বয়স ২২/২৩ হবে, দেখতেও বেশ সুন্দর।সে অসহায়ভাবে বললোঃআমি কিছু করিনি। মেয়েটি বললো রেগেঃ আমি কি বলেছি আপনি কিছু করেছেন? আমার চুল আঁটকে গেছে আপনার প্যান্টের বোতামে, ছেড়ে দিন।
বালাঃ আমি কিভাবে ছাড়বো আমি তো ধরিনি। আমি নড়তে গেলে পরে যাবো তো।
তারপর মেয়েটি বললোঃ আমি কি বলেছি আপনি ধরেছেন, আমার খুব লাগছে, আমিও ছাড়াতে পারছি না।মামা ছুটাও তো আমাকে।
তারপর মেয়েটির প্রৌঢ় মামা চুল ছুটাতে এগিয়ে আসেন। বললেনঃ কি যে করিস না শৈল, দেখে চলতে পারিস না।
মেয়েটি বললোঃ আমি কি করলাম মামা? এটা এক্সিডেন্ট।তাড়াহুড়োয় ভীড়ের মাঝে ট্রেনে উঠতে গিয়েই এমন হলো।
তারপর বালা ট্রেনের বগিতে তার সীট খুঁজে বসলো। ও মা একি, তার সামনের সীটে ব্যাগ উপরে রেখে সেই মেয়েটি তারই সামনে বসলো, বালার মনে থেকে হারিয়ে গেল অন্ধ ভিক্ষুক মেয়ের কথা। সে এখন তার সহযাত্রীর সাথে কিভাবে তিন ঘন্টা সফর করবে। ভেতরে ভেতরে দরজায় ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য সরি বলবে বলবে প্রস্তুতি নিচ্ছে।মেয়েটির তার দিকে কোন মনোযোগ নেই। সে জানালা থেকে মুখ বের করে তার মামাকে বলছেঃ আমি সীট পেয়েছি মামা, ব্যাগ রেখেছি, বসেছি, তুমি চিন্তা করো না, মামীকে বলো, পরীক্ষা শেষে আমি আসবো, মন খারাপ করো না।মেয়েটি কাঁদছে।
এবার ট্রেনের জানালায় বয়স্ক লোকটিকে দেখলো, তিনিও চোখ মুছতে মুছতে কাঁদতে কাঁদতে বললেনঃ নিজের যত্ন নিস মা, সময়মত খেয়ে নিস, আমাদের জন্য চিন্তা করিস না।
মেয়েটিঃ তুমি কেঁদো না মামা, আমি ভাল থাকবো।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, এদের কান্না থামছে না, মেয়েটি বললোঃ আসি মামা।
ভদ্রলোক ট্রেনের সাথে দৌড়াতে দৌড়াতে কাঁদতে কাঁদতেঃ আল্লার হাতে সোপর্দ মা।
তারপর যতক্ষণ দেখা গেলো মেয়েটি প্লাটফর্মে দাঁড়ানো ঐ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থাকলো আর চোখের পানি মুছতে লাগলো হাতের টিস্যু পেপার দিয়ে, হঠাৎ হাতের টিস্যু পেপার বাইরে পরে যাওয়ায় বালা তার ব্যাগের পকেট থেকে টিস্যু পেপার মেয়েটির সামনে ধরলো, মেয়েটি নিজের অজান্তেই তার থেকে টিস্যু নিচ্ছে, চোখের পানি, নাকের পানি মুছে নীচে ফেলছে। একসময় মেয়েটা জানালা থেকে সরে তার সীটে বসলো, তার দিকে না তাকিয়ে টিস্যুর জন্য ধন্যবাদ দিল। সীটে বসেও তার চোখ যেন পানির সরোবর। আহা এতো কান্নার কি আছে?
বালা কিছুক্ষণ দেখে মনে মনে বললো কি ছিচঁ কাঁদুনী নাটক পরিবার বাপ! তারপর সে বাইরের দৃশ্য দেখতে লেগে গেল।
কিছুক্ষণ পর মেয়েটি তার পানির বোতলের পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নিলো, জানালার বাইরে মুখ বের করে, কি চমৎকার এ দৃশ্য। মেয়েটিকে কি সুন্দর লাগছে, মনে বাজছে 1942 A Love Storyর গানঃ এক লারকি কো দেখা তো এয়সা লাগে, যেয়সে খিলতা গোলাব, যেয়সে শায়ের কা খাব,যেয়সে উজলা কিরণ…যেয়সে মন্দিরমে হো এক জ্বলতা দিয়া…….. মনে এ গান গাইতে গাইতে বালা মুগ্ধ হয়ে মেয়েটিকে দেখছিলো এমন চোরা চোখে যেন মেয়েটি না বুঝে। মেয়েটির মুখ ধোয়ায় এমন কি আছে?
কেন ভাল লাগছে বালার? কেন টানছে মেয়েটি তাকে?
বালা ইন্ট্রোভার্ট, ভেতরে ঝড় হলেও কেউ বুঝে না বালার শান্ত রূপ দেখে ভেতরে তার আবহাওয়ার কি খবর? মেয়েটিও বুঝলো না বালার মনের খবর।
তারপর মুখ মুছলো টিস্যু পেপার দিয়ে। ভাল লাগছে দেখতে বেশ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে শরতের মেঘমুক্ত আকাশের ও রৌদ্রজ্জ্বল সৌন্দর্য্য মেয়েটির মুখে এখন। বালা মনে মনে বললোঃ বাঙ্গালী মেয়েরা কাঁদেও বেশী, স্বাভাবিক হয় ও তাড়াতাড়ি।এখন কত আত্মবিশ্বাসী ভাব অথচ একটু আগেই তার মুখে ছিল ঝড়ের ১২ নম্বর বিপদ সংকেত।
এবার মেয়েটি তার দিকে ধন্যবাদ সূচক দৃষ্টিতে তাকালো।বালা একটু স্মিত হেসে বললো, আমি বালা। আপনি?
মেয়েটি বললোঃ আমি শৈল।
বালাঃ দরজার ঘটনা আমার ইচ্ছাকৃত নয়, দয়া করে ক্ষমা করবেন।দেখুন, আমি আর যাই হই কোন মেয়ের সাথে অভদ্র আচরণ করতে পারি না।
শৈলঃ আমি তো আপনাকে দোষারোপ করিনি। ভুল আমার। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গেছি ট্রেনে, তাইতো এমন হলো। এজন্যই আমার মামী বলে, শৈল একটু সাবধান হ, এতো তাড়াহড়ো করিসনে, তাড়াহুড়োয় কাজে ভুল হয়, আরো ঝামেলা বাড়ে।শৈল কি শুনে সে কথা? শৈল করে সেটাই যা তার ভালো লাগে।
মাথা নাড়িয়ে হাতের ইশারায় চোখে চোখ রেখে বলছিলো শৈল।
কারো চোখ এতো সুন্দর হয় কাজল কালো গভীর মায়াবী দৃষ্টি,
মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছে আর শুনছে বালা, ছেয়ে যাচ্ছে শৈল তার মাঝে, প্রশান্তি ছড়াচ্ছে তার মনের প্রচন্ড গরম দুপুরে। মেয়েটির মাঝে কোন কপটতা নেই, কত সরল সাবলীলভাবে তার মতো অজানা অচেনা মানুষের কাছে নিজেকে প্রকাশ করছে। বালা যে নিজের অজান্তে “ গুন গুন গান গাহিয়া নীল ভ্রমরা যায়…… “ গান করে তার মনের দুয়ার খুলে কখন এই মিষ্টি মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি কি সেটা বুঝতে পারছে?
না না বালা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ কর। মেয়েটিকে বুঝতে দেয়া যাবে না। তাই মনে মনে “ মন বাড়িয়ে আছি দাঁড়িয়ে তোমাকে নিয়ে যাবো হারিয়ে বহুদূর” গাইতে ইচ্ছে করলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো কারণ ওপাশের চন্চল তরুণী তার কাছে নতুন, তাকে সে জানে না।
তারপর বালা বলেঃ আপনার মামী ঠিক বলে আপনার সতর্ক হওয়া হয়তো দরকার তবে আমার সাথে হয়তো এভাবেই আপনার পরিচয় হবার কথা ছিল। কি করেন আপনি? কোথায় যাচ্ছেন?
……,,
পরিচয় থেকে সেদিন তারা পরিচিত হতে হতে আরো একটু পরিচিতি বাড়ে তাদের, যোগাযোগের মাধ্যম তৈরী করে তারা,
যদিও কেউ কাউকে কখনো মেসেজ পর্যন্ত করেনি তারপরও ভুলতে পারে না বালা শৈলকে। তার চোখ খুঁজতে থাকে শৈলকে চারদিকে।এরপর মাস ছয় পর আবার ঈদের সময় বসুন্ধরা শপিং মলের লিফটে প্রচন্ড ভীড়ে একটা মেয়ে এসে তার বুকের উপর আছড়ে পরে এবং মাথা দিয়ে একটা জোরে ধাক্কা দিলো তাকে, ঘটনায় হতভম্ব বালা, মেয়েটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না অথচ ভীড়ের মধ্যে তারই বুকে মেয়েটা, মেয়েটার নিঃশ্বাস পরছে তার বুকে, কিছু বুঝতে পারছে না বালা, পেছন সরার জায়গা নেই, মেয়েটির ও পিছে যাবার জায়গা নেই, বড় কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্হা, মেয়েটা পেছনে ফিরে
তার বান্ধবীকে বললো, পলা করছিস কি? ধাক্কা দিচ্ছিস কেন?
পলা মানে পেছনের মেয়েটি বললো, আরে আমি না ভীড় আমাদের ঠেলছে। মেয়েটি এবার তার দিকে মুখ তুলে সরি বলতে বলতে চাইতেই বালার শরীরে যেন এক পরম প্রশান্তি ছেয়ে যায়ঃ আরে শৈল আপনি? কেমন আছেন?
শৈলঃ ভাল তবে আজ আমি সতর্ক ছিলাম, ভীড়ের জন্য আপনার সাথে ধাক্কা লেগে গেলো। ঈদের সময় বুঝেন তো।
আচ্ছা ঠিক আছে বলে বালা। গরম অনেক, চলুন ঠান্ডা কিছু খাই, আপনার সাথে জরুরী কথা আছে আমার।
তারপর তারা বালার নিমন্ত্রণে বসুন্ধরায় একসাথে ফালুদা খায়, বালার সাথে যোগাযোগ রাখবে বলে চলে যায় শৈল। যোগাযোগ বাড়ে, শুরু হয় কথা বলা, অফিস শেষে, শৈলর ক্লাস শেষে একসাথে দুজনের পথ চলা, পাশাপাশি হাঁটা, নানান স্বপ্নের জাল বোনা, তারপর বছর দুই পর দুই পরিবারের সম্মতিতেই তাদের বিয়ে হয়, কখন পেরিয়ে গেছে শৈলর সাথে বালার গাঁটছড়া বাঁধার পর পাঁচ বছর প্রায়। মনে হয় এই তো সেদিন, এখন আর আগের মতো শৈল তার গায়ে ধাক্কা খায় না, কেমন ভারী ব্যক্তিত্ব এখন শৈলর। তার পরিবারের যাঁতাকল সেই উচ্ছল ঝর্ণার মতো চপল শৈলকে তার থেকে কেড়ে নিয়েছে।
তবুও এখনও সব কষ্ট চেপে শৈলই তাকে পরিপূর্ণ করে রেখেছে। বালা নিজেকে প্রশ্ন করে সে কি জানে না কতখানি নিষ্ঠুর তাকেও হতে হয়েছিল শৈলর সাথে, শৈল না জানলেও সে জানে সে নিজে দায়ী শৈলর মা হতে না পারার জন্য, অপরাধ কি তার একটা?
আজ শবে বরাত, আর পারছে না বালা একা এ অপরাধের বোঝা বইতে, ক্ষমা চাইবে আজ শৈলর কাছে।
স্মৃতির মানসপটের ছবির এলবাম বন্ধ করে বালা শৈলকে বললোঃ আজ শব ই বরাত, আমাকে যেনো আল্লাহ ক্ষমা করে, দোয়া করো শৈল।
শৈল মজা করার ছলে বলেঃকি গুণাহ তোমার সেটা বলো, আমাকে তো জানতে হবে তোমার ওকালতি করার আগে, ডাক্তার আর উকিলের কাছে কিছু গোপন করতে হয় না।
বালার গলা ভারী হয়ে আসে, বলে কয়টা বলবো, তুমি পারবে ক্ষমা করতে?
শৈল চিন্তিত হয়ে বলেঃ এই কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন তুমি? কি করেছো তুমি? আমি তো দুষ্টুমি করছিলাম। কিছু খাবে চা করে আনবো? শরীর ভাল তোমার?
বালা শৈলর দু হাত ধরে বলেঃ প্লিজ কোথাও যাবে না তুমি, আজ না বললে আমি আর জীবনে তোমাকে বলতে পারবো না।
শৈলঃ আচ্ছা বলো আমি শুনছি, দ্রুত বলবে, নামাজ পড়তে হবে।
বালাঃ তুমি জানো কেন তুমি মা হতে পারছো না? কেন তোমাকে আমার মা বাবার খোঁচা সহ্য করতে হয়?
শৈল দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলেঃ কি আর করা বলো, আমার কপালে যদি দুঃখ থাকে তবে তুমি কি করবে?
বালাঃ না শৈল, দু হাতে শৈলর মুখটা ধরে এতো ভালো কেনো তুমি? বকো আমায়।
বালাঃ আমাদের প্রথম বাচ্চার খবর যখন তুমি আমায় দিলে আমার মা বাবা বোন আর আমি প্রস্তুত ছিলাম না, আমার পরিবার চাইছিল একটি বিয়ের অনুষ্ঠান যদিও তোমার মামা মামী একবার অনুষ্ঠান করেছিলেন, বাবা মা আমাকে তাদের পছন্দমতো বিয়ে দিতে না পারায় কিছু অন্যায় আবদার সবসময় করতেন যার মধ্যে একটি ছিলো তোমাকে সম্মত করে বা টেকনিকাল চাপাচাপি করে তোমার মামাকে দিয়ে বাবা মায়ের খুশিমত পাঁচশ লোককে দাওয়াত খাওয়ানো, এমন পরিস্হিতি যখন তখন তোমার মা হবার ঝক্কি মানে মায়ের স্বপ্নে পানি ঢালা, আমি ভাবলাম পরে বাচ্চা নেবো আমরা। তাই দোকান থেকে একটা ঔষধ এনে তোমাকে খেতে দেই, তোমাকে খেতে দেই এই বলে বাচ্চার আর তোমার জন্য ভাল হবে বলে, তুমি সরল বিশ্বাসে খেয়ে নাও সেই ঔষধ, সাথে সাথে তোমার পেটে ব্যথা শুরু হয়, তুমি ব্যথায় মাগো মাগো বলে চিৎকার করতে থাকো, আমি বুঝতে পারি ঔষধ কাজ শুরু করেছে, কিছুক্ষণ পর তোমার ব্লিডিং শুরু হয়, তারপর মায়ের নার্স বান্ধবীর ক্লিনিকে নিলে তারা পরীক্ষা করে বলেন, বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে, মিস ক্যারেজ আংশিক হয়েছে, ঐ আন্টি না বুঝে ডি এন সি করার সময় তোমার জরায়ু ফেটে যায় – হারায় বাচ্চা ধারণ ক্ষমতা। এজন্য তোমার বেশ কয়েকটি মিস ক্যারেজ হয়।
শৈল দম বন্ধ করে শুনছিল বালার কথা, বললোঃ এ কি করলে বালা, কেন করলে তুমি এটা, আমি আর শুনতে চাই না।
বালাঃ আজ কষ্ট করে শোন দয়া করে, কাল হয়তো আমি আর বলতে পারবো না, তারপর তোমার মামা মামীকে তোমার বাচ্চা নষ্ট হবার এক রকমের গ্লানি দিয়ে আমার পরিবার সেই কাংখিত দাওয়াত আদায় করে, সব কিছুতে তুমি গুটিয়ে নাও নিজেকে, আর আগের মতো হাসো না, যে যা বলে তাই নির্বোধের মতো করে যাও, আমি দেখি, তারপর আসে তোমার বিসিএস এর রেজাল্ট, তুমি বিসিএস এ সিলেক্ট হয়েছিলে, বাবা মা বললেন তুমি চাকরী করলে আর ঘরের প্রতি যত্নবান হবে না, বউয়ের বাড়ীর বাইরে কাজ শয়তানী চিন্তা- আমি চাইনি তবে একরকম বাধ্য হলাম তোমাকে সেই খবর না দিতে- যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকো তুমি- তোমার আমার একসাথে দেখা স্বপ্ন তোমার কেরিয়ার গড়া, পরিবারের পাশে সমাজের জন্য কাজ করা আমি পারিনি বাস্তবায়ন করতে, উল্টে তোমাকে কামাই করো না দেখে, বাচ্চা হয় না দেখে আমার পরিবার, স্বজন, সবার বাঁকা কথা সহ্য করতে হয়, অন্যদের সাথে তোমার তুলনা করে তোমাকে ছোট করা হয় যেনো তুমি মাথা তুলে নিজের আত্মসম্মান না খোঁজ, সবার পায়ের জুতা হয়ে থাকো।
শৈলঃ এসব কি বলছো বালা? আমি তোমাকে চিনি না, তুমি আমার সামনে থেকে যাও। অনেক কষ্টে অভিমানে কেঁদে কেঁদে বললো শৈল। ঠিক আছে যা হবার হয়েছে – আমি নামাজ পড়বো- তুমি যাও
বালাঃ না আজ আমায় বলতেই হবে, আমার বাবা মায়ের পীড়াপীড়িতে তুমি বোরখা পরতে বাধ্য হলে যা আমিও চাইনি, তবু সংসারের সুখ চিন্তা করে তুমি বাধ্য হলে- আমি জানতে পারলাম এমন পর্দার জোরাজুরি করার কথা নেই ধর্মে। এরপর আমার বোনের বিয়েতে আসার সময় রাস্তায় তোমার মামা মামীর গাড়ী এক্সিডেন্ট হয়, মুমুর্ষ মানুষ দুজন তোমাকে শেষবারের মতো দেখতে চায়, আমি তোমাকে না পেয়ে আমার মাকে জানাই, মা বললেন, এখন না বোনের বিদায় হবার পর তুমি যেতে পারবে। সেদিন চেয়েও সংসারের অন্যায় চাওয়া থেকে মুক্ত করে আমি তোমায় নিতে পারিনি হসপিটালে তোমার মামা মামীর কাছে- যারা তোমাকে নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করেছেন, এমনকি আমি জানতাম তাদের আর কোন সন্তানও নেই। তবুও সেই লৌকিক প্রয়োজন উপেক্ষা করে আমি তোমার পিতা মাতা তুল্য মামা মামীর কাছে তোমাকে শেষ দেখা করার জন্য নিতে পারিনি। বোনের বিদায় হবার পর তুমি নিজের ফোনে মামার এতো ফোন দেখে কল করে জানলে তারা মারা গেছেন। তোমার বুকফাটা আর্তনাদে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে যেন মামা বাড়ি নিয়ে যাই।সেখানে তুমি তিন চারদিন থাকো তখন, একদিন মামার উকিল এসে জানায় মামা মামী তাদের ব্যবসা ও বাড়ী ব্যাংক ব্যালেন্স সব তোমার নামে লিখে দিয়ে গেছেন। বাবা বললেন, তুমি এসবের কি বুঝবে তাই তোমাকে যেন না জানাই। সেই থেকে আমি সব দেখাশুনা করছি গোপনে। তবে একটা পয়সাও আমি খরচ করিনি সব তোমার নামে ব্যাংকে জমানো আছে, তোমার বিসিএস পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করে জমা দিয়েছি, বই কিনে এনেছি, কোচিং সেন্টারে তোমার ভর্তির ক্লাশ শুরু সামনের রবিবারে, আর একটা কথা, এতো অপরাধ ক্ষমা করা সম্ভব নয়, আমি তোমায় জোর করবো না, অনেক সহ্য করেছো তুমি। তোমার সব সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নেবো।
এবার সজল চোখে বালা বলেঃ তোমার বিসিএস পরীক্ষার আগে আমরা সরোগ্যাটেড পদ্ধতিতে বাবা মা হতে পারি যদি তুমি চাও, আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে একজন সরোগেটেড মা যোগাড় করে সব ব্যবস্হা করে রেখেছি।আজ থেকে তোমার বোরখা পরারও প্রয়োজন নেই, তুমি মু্ক্ত, তুমি স্বাধীন, বিয়ে করেছো, দাসত্ব হবার পত্রে দস্তখত করোনি। আমাদের নোংরা মানসিকতা দিয়ে আমরা ঘরের বউদের শোষণ করি, দাসত্ব করতে বাধ্য করি, তাদের দুর্বল করার সব নোংরা খেলা খেলি, বিয়ে মানে বন্ধুত্ব দাসত্ব নয়। তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ তবে একা ঘরের বউ কেন এ সমাজের নোংরা রীতিনীতির শিকার হবে? আমি সম্মান করলে তুমি করবে নয়তো নয়। বিয়ের পর এতো অন্যায় কেন মাথা পেতে মেনে নাও তোমরা? আর আমরা তোমাদের সেই ভদ্র নম্র স্বভাবটার ফায়দা নেই কখনও ধর্মের নামে কখনও সামাজিকতার দোহাই দিয়ে? লাথি মারো না কেন এমন সংসারে? কি সে কম তুমি? যোগ্যতায়। ও গুণে তুমি আমাদের চেয়ে বড়মাপের মানুষ – আমরা তোমাদের ভদ্রতাকে দুর্বলতা ভাবি, তোমরা বুঝতে পারো না আমাদের?
যদিও জল অনেক গড়িয়েছে নোংরা নালার, আমার গায়ে নিজের সন্তান হত্যার গন্ধ লেগে আছে, ঐ বাচ্চার কান্না আমি শুনতে পাই, ও আসে সাদা কাপড়ে মোড়া হয়ে বলেঃ কেন মেরেছো আমায়, কত শান্তিতে ছিলাম মায়ের পেটে।
পারো যদি আমাকে ক্ষমা করো, আমি তোমায় আজো অনেক ভালবাসি তবে তোমাকে রক্ষা করতে পারিনি এ সমাজের নোংরা ভাবনার বলি হওয়া থেকে, ক্ষমা করো আমায়, বলে বালা আর দাঁড়ালো না বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
শৈল পাথর হয়ে বসে রইলো বিছানায়।
এ কোন বালা? একেই ও ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো।হায়রে!
তারপর চোখ বন্ধ করে মামা মামীর মুখ যেন দেখলো সে, মামা বললেনঃ মা যে ক্ষমা করে আল্লাহ তাকে ভালবাসেন, তুই আবার বাগান সাজা, মামী বললেন ফুলে ফুলে সাজা বাগান শৈল মা। ক্ষমা করে দে বালাকে।
শৈলঃ না আমি পারবো না, আমি পারবো না। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে কোন রকম নামাজ সেরে জায়নামাজের উপর শুয়ে ঘুমিয়ে যায়।
শৈলর কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে বালা রুমে আসে, দেখে অজ্ঞান হয়ে জায়নামাজে পরে আছে শৈল। এবার আর বাবা মাকে ডাকে না বালা। শৈল তার স্ত্রী – ওর ভাল মন্দ বালা দেখবে। সে এম্বুলেন্স কল করে, নিয়ে শৈলকে শহরের ভাল একটি হসপিটালে, ডাক্তার বলেন শৈল আবার প্র্যাগন্যান্ট, খবর দেয়া হয় সরোগ্যাটেড মাকে। ততক্ষণ শৈলর জ্ঞান ফিরে। সে সরোগ্যাটেড মাকে বলেঃ আপনি বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত আমার সাথে আমার বাসায় থাকবেন।
তারপর বালার দিকে তাকিয়ে বলে হসপিটাল থেকে আমি সরোগেটেড মা সহ আমার মামার বাসা মানে আমার বাসায় যাবো। তুমি আমার জন্য অনেক করলে ধন্যবাদ।
তোমার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি, বিসিএস পাশ করি, মামার স্বপ্ন ছিল একটি বিশ্বমানের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে একটি ফলিত কলা ও বিজ্ঞান কলেজ খোলার, আমি তার স্বপ্ন পূরণ করবো। আমার ব্যাংক একাউন্ট ব্যাবসা বাড়ী সম্পদ আমি দেখতে পারবো, তোমার কষ্ট করার প্রয়োজন নেই।
ভাল থেকো তুমি, আমাদের বাচ্চা হোক সে সিদ্ধান্ত নেবে তোমার শাস্তি কি হবে?
নির্বাক বালা, অনেক কষ্ট করে বললোঃ ঠিক আছে, কোন প্রয়োজন হলে জানিয়ো, আমি সারাজীবন তোমার।আমার মনের দরজা সবসময় খোলা শৈল।
শৈলঃ আচ্ছা যাও, দেখতে ইচ্ছে করছে না তোমায়।
বালা মন মরা হয়ে হাঁটছে রাস্তায়, ফোন বেজে উঠে তার,
ওপাশ থেকে শৈলর গলাঃ এই তুমি বাবা হচ্ছ, কত কিছু কিনতে হবে বাবুর জন্য সে খবর আছে, আমাদের তোমার গাড়ীতে মামার বাসায় রেখে বাজার করতে যাও। বাবুর দাদা দাদীকে দোয়া করতে বলো।
বালা বললোঃ আমি আসছি শৈল, আমি এক্ষুনি আসছি।
শৈলঃ আমি জানি আসি আসি বলে ঘন্টা পার করবে তুমি বাবুর আব্বু, তাড়াতাড়ি আসো, আমরা কতক্ষণ হসপিটাল থাকবো আর, শুনছো তুমি? কত কাজ আর এখন…..,,,,,,,
বালা ফোন রেখে তার শ্রষ্টাকে ধন্যবাদ দিল বললোঃ আমার শৈলকে ভাল রেখো, আমাদের সন্তানকে ভাল রেখো। অনেক অনেক ধন্যবাদ, তুমি শৈলদের এতো ভাল বানিয়েছ তাইতো আমরা শৈলবালা ভালো থাকার স্বপ্ন দেখি। বহুদিন পর বুকের পাথর যেন সরে যায়, বেশ ফুরাফুরা লাগে নিজেকে। সে আবার বহুদিন পর মনে মনে গান গায়ঃ আজ মনে হয় এই নিরালায়,
সারা রাত ছন্দের গান শুনি,আমি এক স্বপনের জাল বুনি।