শুক্রবার। ছুটির দিন। মেঝেয় সতরঞ্চি পেতে একটু গড়াচ্ছি। মেঝে থেকে শীতভাব উঠে আসছে শরীরে। বাইরে রোদের মুখে ছায়া পড়েছে। মেঘ করল নাকি? বুকের ওপর সিলিং ফ্যানটার ঝকঝকে ইস্পাতের রঙ্গের ব্লেডগুলো একটা প্রকান্ড স্থির বৃত্ত তৈরী করছে। ঘূর্ণিঝড়ের মতো। বাতাস নেমে এসে মেঝেতে চেপে ধরেছে আমাকে। রান্না ঘরে বাসন কোসনের টুকটাক।অহনা রান্না করছে। বাথরুমে জলের শব্দ। জানালার নীল পর্দা ঘরে একটা নীল আভা।
আমার মন ছুটে চলছে শত অলিগলি তে। ছোট বেলায় আব্বা-আম্মার মুখে কলকাতার গল্প শুনে আমার মন বলত- কলকাতা, কলকাতা!
আমার ছোট বেলা কেটেছে স্বপ্নের দেশ মাটিরাঙ্গায়। চারদিকে ঘন গাছের বেড়াজাল। বৃষ্টি পড়ত খুব, আবার রোদ উঠলে বুনো ফুলের গন্ধে ম-ম করত বাতাস। রাতে ফেউ ডাকতো, শেয়াল কাঁদতো, আমাদের বাসার আনাচে-কানাচে এঁটো কাঁটা খেতে আসত শুয়োরের মত মুখ ওয়ালা বাগডাশ। ঝিঁঝির ডাক রাতে অরণ্যকে গভীর করে তুলত। শীতকালে পড়তো অসহ্য শীত, মাটির তাপ কুয়াশার মতো হয়ে বর্ষাকালে আড়াল করতো সব। পাহাড়ী পথ হঠাৎ বাঁক ঘুরে রহস্যে হারিয়ে যেত। সেখানে দাওয়ায় বসে আব্বা আম্মা করতেন কলকাতার গল্প। বেশীর ভাগই কলকাতার দৃশ্যের গল্প, গাড়ী ঘোড়া, আলো, দোকান আর লোকজনের গল্প। আর নানা বাড়ীর গল্প। সেই কলকাতা আমার মনে বীজের মতো ঢুকে যায়। মাটিরাঙ্গা ছিল ছোট মফস্বল, সুন্দর ছিমছাম। লোকজন বেশী না, গাড়ী ঘোড়া বেশী না, চারদিকে জঙ্গল ঘেরা ছোট উপজেলা।
তারপর আব্বা বদলী হলেন চট্টগ্রাম শহরে। আর তখন থেকেই আমার মনে কলকাতা নামের বীজটি ফেটে অঙ্কুর দেখা দিয়েছে। গল্প কবিতা উপন্যাসে কলকাতার আরও সব বিচিত্র গল্প শুনে সেই বীজটি অঙ্কুরিত হয়। শাখা প্রশাখা জন্মায়। বেড়ে গজায় ডাল পালা।
পাশের বাসার এক কাকার ক্যান্সার হয়েছিল, তিনি গেলেন চিকিৎসার জন্য কলকাতা। কবি সাহিত্যিক রা ছুটে যান কথায় কথায় কলকাতায়।
আমার এক স্যার ছিলেন অঞ্জন চৌধুরী, উনি কথায় কথায় বলতেন এদেশে কিচ্ছু হবেনা, শিখতে হলে যেতে হবে কলকাতায়। আর আমার মন বলতে থাকে কলকাতা,কলকাতা!
কৈশোরে মাথায় গেঁথে গিয়েছিল, মানুষকে কলকাতা সব দিতে পারে। খ্যাতি, টাকা, প্রাণ পর্যন্ত। আমার কৈশোরের নাকে ভাসত কলকাতার গন্ধ। আমার কৈশোরের কল্পনায় কলকাতা ক্রমে ক্রমে এক বিশাল ব্যাপক রাজত্ব স্থাপন করে। কলকাতায় যেন বা আলাদা সূর্য ওঠে, আলাদা চাঁদ, কলকাতা শূন্যে ভাসমান বুঝি বা। কলকাতাকে ঘিরে যে সব কল্পনা আমার সে সব কল্পনা কলকাতার দিগ্বিজয়ী সৈন্যদলের মতো আমার ভেতরটা তছনছ করে দিয়ে চলে যেত। আমার চোখে ভাসত কলকাতার জিপিওর ঘড়ি, হাওড়ার ব্রীজ, ভিক্টোরিয়া মনুমেন্ট, বিড়লা তারাঘর, চিড়িয়াখানা।ক্রমেই মনে হতো কলকাতা মন্ত্রের মতো। কিংবা কলকাতা জীবন্ত নারী , তার বুকে রহস্যের শেষ নেই,সীমাহীন তার নিষ্ঠুর উদাসীনতা, চুম্বকের মতো তার আকর্ষন। দুর -দুরান্ত থেকে তার প্রেমিকরা ছুটে চলে কলকাতার দিকে। কলকাতা এক প্রেমিকারই নাম। জ্বলন্ত দূর্বার এক প্রেমিকা রমণী কলকাতা।
কলেজ জীবন শেষ করলাম কলকাতার প্রতি প্রেম পুষে পুষে।
বহুদুর থেকে একটা যৌবন কালের প্রতীক্ষা নিয়ে প্রথম যখন কলকাতার রাস্তায় নামলাম তখন আর রাস্তার কষ্টের কথা মনেই ছিলো না। রবীন্দ্র সেতু পার হবার সময় শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছিল। সে শব্দে মনে হচ্ছিল বুকের ভেতর কলকাতা ঢুকে যাচ্ছে বুঝি। হাওড়া স্টেশনে পা দিতেই মনে হলো প্রেমিকার উঞ্চ বুকের মধ্যে চলে এলাম বুঝি। গর্জমান এক কামুক নারী যার শিরা -উপশিরায় প্রাণস্রোত। সে নারীর আদরে চোখ বুজে এসেছিল বুঝি আমার।
কলকাতা আমার চারপাশে সর্বক্ষন শৈশব কৈশোরের প্রথম প্রেমের মতো বিস্মৃত রঙ্গীন স্মৃতির মতো হয়েই রইলো।
মুম্বাইয়ে মেডিকেলের হোস্টেলে কিংবা বড় আপার বাসায় শুয়ে শুয়ে সারাক্ষণ আমার শিরায় শিরায় উল্লসিত রক্তের স্পন্দনে কলকাতার শব্দ শুনতাম আমি। বিছানায় উপুড় হয়ে শুলে আমি টের পেতাম আমার যুবক বুক বুঝি কলকাতার পাথুরে বুকের সাথে লেপ্টে আছে। একের হৃদস্পন্দন বুঝি মিশে আছে আর একজনের সাথে।
সিলিংফ্যানের ঝকঝকে ইস্পাতের রঙ্গের ঘূর্ণী বৃত্তটা দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি। উঠে দেখি রোদের মুখে বসেছে কালো মেঘ। পুবের বাতাসে পর্দা উড়ে আসছে।
আহ বৃষ্টির পর কলকাতা বড় সুন্দর সাজতো। সূর্যের শেষ আলো সিঁদুর-গোলা রঙ ঢেলে দিত রাস্তায় রাস্তায়। গড়িয়াহাটার বাড়ী গুলোর গায়ে সেই অপার্থিব রঙ ছড়িয়ে পড়তো। জলে ছায়াছবি। আহা! কলকাতা আমার কলকাতা।