নভেম্বরের ১ তারিখ আমরা সিমলা ভ্রমণে বের হই।কিন্তু
এর প্রস্তুতি দেশে থাকতেই শুরু হয়। সিমলা ভ্রমণের
জন্য দিল্লি থেকে যাবার প্রধান বাহন সিডান কার।দিল্লিতে অনেক ট্রাভেল এজেন্সি বা কোম্পানি আছে। ভাগ্নেকে বলেছিলাম তাদের কারও সাথে যোগাযোগ করে একটা ভ্রমণসূচী করতে। সে কথা মোতাবেক একটা কোম্পানির সাথে কথা বলে। তারা বেশ বড়ো রকমের ভাড়া দাবী করে। ইতোমধ্যে দেশেই আমার পরিচিত এক দাদার সাথে যাবার আগে দেখা হলে আমি কথা প্রসঙ্গে সিমলা ভ্রমণের কথা বললে তিনি জানান বছর দুয়েক আগে তাঁরাও সিমলা গিয়েছিলেন দিল্লি থেকে কারে। তিনি তেজবীর নামে একজন ড্রাইভারের খুব প্রশংসা করলেন এবং তার ফোন নম্বর দিলেন।
আমি তেজবীরের ফোন নম্বর জয়কে দিলে ওর সাথে কথা বলে। তেজবীর ৫ রাত ৬ দিনের একটা ট্যুর প্ল্যান দেয়।এতে আবাসন সহ সকাল ও রাতের খাবার অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে যা দাবী করলো তা আগের কোম্পানির শুধু গাড়ি ভাড়ার চেয়েও কম।আমাদের আর হোটেল বুকিং এর ঝামেলা থাকলো না,সকাল ও রাতের খাবারের টেনশন নেই।জয়কে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিলে আমরা দেশে থাকতেই তেজবীরকে ৫০০০ রুপি অগ্রিম পাঠিয়ে দেয়।
যাত্রার আগের রাতে ৩১ অক্টোবর কথা হয়।জয় তাকে যেতে বললে সে জানায় তার অন্য কোথাও যেতে হবে।সনু নামে একজন খুব ভালো ড্রাইভার আসবে। জয় বারবার তাকে এ বিষয়ে সতর্ক করে দিলে সে বলে এ নিয়ে চিন্তা না করতে।

সস্ত্রীক লেখক অরূপ গোস্বামী
পহেলা নভেম্বর ভোর পাঁচটায় আমরা বেরিয়ে যাই। হুন্দাই কোম্পানির সিডান কার,খুব সুন্দর। ড্রাইভারও সুন্দর, হিন্দি ও ইংরেজিতে সমান পারদর্শী এবং খুব ভদ্র।সকাল সাতটা নাগাদ মুনথালে সকালের খাবারের বিরতি।ড্রাইভারকে খেতে ডাকলে সে বিনয়ের সাথে খেতে অস্বীকার করে গাড়িতেই বসে থাকে। আমরা মামনির পরামর্শ অনুযায়ী পরোটা অর্ডার দিলাম। এছাড়া দুটো কফিও নিলাম। বেশ ভালো হলো আমাদের সকালের খাবার।
আমরা রওয়ানা দিয়ে কিছুটা পথ যেতেই গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল।দেখলাম সেখানে আর একটা হুন্দাই গাড়ি নিয়ে আর একজন দাঁড়িয়ে আছে। শুনলাম তার নামই সনু।সেই আমাদের নিয়ে যাবে।আগের রাতে দেরীতে ফেরায় অন্য একজনকে পাঠিয়েছিল আমাদের এগিয়ে আনতে। জানলাম সেই তেজবীরের লোক,সে নিয়মিত সিমলা, কুলু,মানালি ট্যুর করে। তার কাছে সিমলা মানালির পুরো ভ্রমণসূচী আছে। কোন কোন হোটেলে থাকবো, কোন কোন স্পট ঘুরবো তার পুরোপুরি
সূচী তার হোয়াটসঅ্যাপে আছে, যা আমাকে দেয়া সূচীর সাথে পুরো মিলে যায়। আমরা নিশ্চিন্ত মনে চলতে থাকি।
দিল্লি থেকে সিমলা যাবার অনেক পথ। মুনথাল, পানিপথ দিয়ে হরিয়ানার রাজধানী চন্ডীগড় হয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চললো।চন্ডীগড় থেকেই পাহাড় দৃশ্যমান হচ্ছিল। চন্ডীগড় পার হবার সময় ক্রিকেটার কপিল দেব এর কথা মনে হলো। এক সময়ের বিশ্ব ক্রিকেটের তিন অল রাউন্ডারের অন্যতম ছিলেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বেই ভারত প্রথম বিশ্বকাপ জেতে ১৯৮৩ সালে।এর আগের দুই বিশ্বকাপেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেবারের ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরাজয় ছিল বিরাট এক বিস্ময়।
যা হোক আমরা বেলা ১২ টা নাগাদ চন্ডীগড় থেকে সিমলার পাহাড়ি পথে চলতে শুরু করলাম। দার্জিলিং এর পথের তুলনায় এ পথ অনেক নিরাপদ মনে হলো। কোথাও কোথাও ডাবল লেন এবং খাদের দিকে রেলিং দেয়া।তবে একইরকম আঁকাবাঁকা পথ।কখনো নামছে,কখনো উঠছে। বেশিরভাগ জায়গায় উপরে উঠেছে। পাহাড়ের গা কেটে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাস্তা করা হয়েছে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে বিকেল তিনটার দিকে আমরা সিমলার উপকন্ঠে পৌঁছে গেলাম। খিদে পাওয়ায় আমরা গাড়ি থামিয়ে খেয়ে নিলাম। এখানেও ড্রাইভার আমরা বলা সত্ত্বেও খেলো না।মনে হয় এখানে আমাদের দেশের মতো ড্রাইভার সহ খাওয়ার চল নেই। পরে অবশ্য শুনেছিলাম ড্রাইভার মালিকের কাছে গাড়ি চালালে ২০০ টাকা খোরাকি পায়।সম্ভবত সেকারণেই যাত্রীদের সঙ্গে খাবারের রেওয়াজ নেই। রুটি, ডাল আর চা খেয়ে আমরা রওয়ানা দিলাম হোটেলের উদ্দেশ্যে।
তখন ড্রাইভার সনু জানালো,হোটেল অনেক দূরে। এখনো যেহেতু সন্ধ্যা হয়নি তাই ম্যাল রোড এবং জাকু মন্দির দেখে যাওয়া যায়।আমরা তেমন ক্লান্ত নই,তাছাড়া দিনের আলোও আছে।তাই সনুর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই।কিন্তু সে সিদ্ধান্ত যে কতটা ভুল ছিল তা পরে টের পাই।কিছুক্ষণ একটা রাস্তা দিয়ে চলার পর আমাদের মনে হলো আমরা যেন ক্রমেই
মূল শহর থেকে দূরে চলে যাচ্ছি। দার্জিলিং ঘুরে আসার কারণে জানি এ রকম শৈল শহরের মূল জায়গা হলো ম্যাল রোড। ম্যাল মানে সমতল। পাহাড়ি শহরে সাধারণত এরকম সমতল জায়গাতেই মূল বাজার দোকানপাট এসব থাকে।
আমাদের কথা শুনে সনু গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে আমরা ম্যাল রোড ছেড়ে এসেছি। সে বলে খুব দূরে আসেনি,বলে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়।পনের কুড়ি মিনিট চলার পর আরও দুএকজনকে জিজ্ঞেস করে আমাদের ম্যাল রোড নিয়ে আসে।
লিফটে করে ম্যাল রোড উঠতে হয়।সে আমাদের লিফটের কাছে নামিয়ে না দিয়ে আমাদের কোন কথা না শুনে গাড়ি পার্কিং করতে যায়।সমতল থেকে নিচের দিকে পাঁচ ছয় তলায় পার্কিং পায়।সেখান থেকে খাড়া সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে আমাদের কাহিল অবস্থা। একে তো হাঁটুর সমস্যা, এর উপর দশ ঘন্টা জার্নি করে লিফটের গোড়ায় পৌঁছাতে আমাদের এনার্জি শেষ। দু’টো লিফট বদলে ম্যাল রোড এলাম।সেখান থেকে জাকু মন্দির প্রায় খাড়া উপরে এক কিলোমিটার পথ।আমরা কিছুটা পথ উঠে আর সাহস পেলাম না।ম্যালেতে নেমে এলাম।কিছুক্ষণ বিক্ষিপ্তঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যা লাগতেই আমরা গাড়িতে ফিরে এসে হোটেলে যেতে বললাম। তখন সে জানায় হোটেল সে চেনে না।ম্যাপ দিতে বললে সে ম্যাপ দিতে পারে না বলে জানায়।এদিকে আমার ফোনের চার্জ প্রায় শেষ পর্যায়ে। যে পাওয়ার ব্যাংক এনেছিলাম তা কাজ করছে না।
আমাকে হোটেলের নাম দেয়া হয়েছিল সেখানে লেখা ছিল whistling pines,কিন্তু ম্যাপে আসছে Royal Jardin whistling pines. সেটাই দিলাম। এক জায়গায় উঁচু থেকে নিচের রাস্তায় যেতে হবে। আমি তাকে সেটা জানালেও সে নিচে না গিয়ে সোজা চালিয়ে দেয়।তার সাথে সঠিক যোগাযোগ স্থাপন করে আমার কথা বোঝাতে প্রায় এক কিলোমিটার পথ সামনে এসেছে। সেখান থেকে গাড়ি ঘোরাতে আরও এক কিলোমিটার যেতে হয়।এরপর গাড়ি ঘুরিয়ে নিলেও প্রচন্ড জ্যাম। গাড়ি একদম চলে না।এদিকে আমার মোবাইল যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যাবে। মোবাইল বন্ধ হলে এই পাহাড়ি শহরে ১৫ কিলোমিটার পথ কিভাবে পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবো
তা নিয়ে মাথা খারাপ হয়ে যাবার উপক্রম।(চলবে)