২০২২ সালের নভেম্বরের ৩ তারিখ সকাল ৯ টা নাগাদ আমরা সিমলা থেকে মানালির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাই।পথে কুলু পেরিয়ে মানালি। সিমলা থেকে মানালির দূরত্ব তিনশো কিলোমিটার মতো। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি তেমন দ্রুত চলে না।সকালের খাবার খেয়ে বেরিয়েছি, পথে কোথাও গাড়ি দাঁড় করিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।চাউমিন( নুডুলস) আর কফি সহযোগে খাওয়া হলো।
কুলু একটা জেলা,মানালি সেই জেলার অধিন।কুলু থেকে মানালির দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। কুলুতেও আমাদের কিছু দর্শনীয় ও করনীয় ছিল। শাল তৈরি দেখা এবং কেনার জন্য কারখানা ঘোরা এবং নদীতে নৌকায় ওঠা আমাদের কর্মসূচিতে ছিল। কিন্তু বেলা শেষ হয়ে আসায় আমরা সেগুলো বাদ দিলাম।তাতেই মানালি পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
হোটেল পার্ক প্যারাডাইসে যখন পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে।। আমরা হোটেলের রুমে গিয়ে বিশ্রামে গেলাম। এখানে অনেক ঠান্ডা। যদিও তাপমাত্রা সিমলার চেয়ে বেশি দেখাচ্ছিল,কিন্তু এখানে শীত অনুভূত হচ্ছিল অনেক বেশি। বিকেলে চা খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে গেলাম রাতের খাবার খেতে।
সকাল ও রাতের খাবার হোটেলেই।রাতের খাবার মোটামুটি ভালোই হলো। ভাত,রুটি দুটোই ছিল। খাবার শেষে চা।এখানে নভেম্বরেই যে পরিমাণ শীত তাতে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কেমন শীত অনুভূত হয় তা বোঝাই যাচ্ছে। পরদিন সকালে হাঁটতে গিয়ে চা বিক্রেতার কাছে শুনলাম নভেম্বরের শেষ থেকেই বরফ পড়তে শুরু করে। কোনো কোনো দিন রাস্তা বরফে ডুবে যায়।দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যায়।তখন লোকজন আসে আনন্দ করতে।রাস্তায় বরফ নিয়ে খেলা করে, ধনী মানুষ ঘরে ঢুকে পুরু কার্পেটের ঘরে বসে হিটার চালিয়ে মৌজ করে।তাদের মতো যাদের প্রতিদিনের উপার্জনের উপর নির্ভর করতে হয় তাদেরকে পড়তে হয় চরম দূর্দশায়।
একেই বলে কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ।
পরদিন সকালে স্নান করে হোটেলে সকালের খাবার খেয়ে বেরিয়ে গেলাম। ড্রাইভার জানালো,রোথাং পাসে যাবার অনুমতি চলে এসেছে। আজকেই সেখানে যেতে হবে।মানালি ঢোকার পথেই অনলাইনে আবেদন করে এসেছিল। প্রতিদিন ৩৫০০ কার এবং ৩৫০০ বাইকের সেখানে যাবার অনুমতি দেয়া হয়, যাতে সেখানে বেশি ভিড় না হয়। গাড়ি প্রতি ৩০০ রুপি করে নেয়া হয়।এছাড়া রোথাং পাসের তাপমাত্রা বিবেচনায় অতিরিক্ত শীতের পোশাক ভাড়া করে নিতে হয়।আমরা পায়ের জুতা এবং গায়ের জ্যাকেট ভাড়া নিলাম ৫০০ রুপি প্রতিজনের জন্য। এছাড়া পশমি মোজা কিনে নেই প্রতি জোড়া ১০০ রুপি করে। তবে রোথাং পাসে গিয়ে দেখলাম সেখানে মোটামুটি স্বাভাবিক ধরনের ঠান্ডা। ভাড়া করা এবং কিনে নেয়া কোনো কিছুই
এখানে দরকার হয়নি।
জীবনে প্রথম বার এতো কাছে থেকে বরফ দেখা।আনন্দে আত্মহারা অবস্থা। তবে পাহাড়ের গায়ে যে বরফ দেখা গেল,সেগুলো অনেক আগের। দূর থেকে সেগুলো যতটা স্বচ্ছ লাগে, কাছাকাছি থেকে ততটা নয়।আসলে এগুলো অন্তত ছয় সাত মাস আগের। বরফ যখন পড়ে বা এর অব্যবহিত পরে গেলে মনে হয় আরও ভালো লাগতো। তবুও রোথাং পাস অনেক আকর্ষণীয় একটা জায়গা। সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উপরে। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকে না।ঘন্টা খানেক সেখানে কাটিয়ে নিচের দিকে রওয়ানা দিলাম।
রোথাং পাসের রাস্তা আমার জীবনের ভয়ংকরতম রাস্তা।
যেমন উঁচু তেমনই বাঁক। আসা যাওয়ার পথে অটল টানেল
ও সোলাং ভ্যালি আছে। অটল টানেল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর নামে তৈরি সম্ভবত এশিয়ার সবচেয়ে বড়ো টানেল। পাহাড়ের নিচ দিয়ে সাত বা আট কিলোমিটার সুড়ঙ্গ খুঁড়ে এই পথ তৈরি করা হয়। এতে মানালি থেকে রোথাং পাসের দূরত্ব অনেকটাই কমে যায়।
এ পথেই সোলাং ভ্যালি। সোলাং ভ্যালি মানালির নিকটেই।শীতের সময় যখন খুব বরফ পড়ে, তখন রোথাং পাসের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, তখন সকলে সোলাং ভ্যালিতেই বরফ খেলা করে। আমরা যখন যাই,তখন শীত শুরু হয়নি তাই সোলাং ভ্যালিতে তেমন আকর্ষণীয় কোনো কর্মকাণ্ড ছিল না।
ফেরার পথে ভাড়া করা জুতা পোশাক ফেরত দিয়ে লাঞ্চ সারলাম মানালির ঐতিহ্যবাহী খাবার মোমো দিয়ে। নেপাল থেকে মোমো খাওয়া শুরু। তবে মানালির মোমো স্বাদে অতুলনীয়। একটু বেশি ঝাল ছিল, সেজন্যেই মনে হয় স্বাদ বেড়েছিল।
বিকেলে ফেরার পথে বশিষ্ট মন্দিরে গেলাম। পাশেই উষ্ণ প্রস্রবণ, সবসময় গরম জল আসছে। সেই জলে কেউ স্নান করছে, কেউবা হাতে নিয়ে চোখে মুখে মাথায় দিচ্ছে। আমিও হাতে নিয়ে জলের উষ্ণতা অনুভব করলাম। রাস্তার দোকান থেকে কিছু কেনাকাটাও সেরে নিলাম।অবশেষে ক্লান্ত দেহে রুমে ফিরে এলাম। (চলবে)