আবহমানকাল থেকে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মমপূত্র, তিস্তা, মধুমতি, গড়াই, মহুরী, গমতিসহ হাজারো নদ-নদীর অববাহিকায় পলি মাটি দ্বারা গঠিত আমাদের এদেশ। ৮০’র দশকের পূর্বে যখন আমাদের দেশের কৃষিতে সেচ ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির ছোয়া লাগেনি, তখন আমাদের ফসল উৎপাদন প্রকৃতির লীলা-খেলার উপর নির্ভশীল ছিল। বৃষ্টি কম হলে, খরায় ফসল উৎপাদন ব্যহত হত। আবার যে বছর উজানে ও আমাদের ভূভাগে অতিবৃষ্টিপাত হত, সে বছর বন্যায় ফসল নষ্ট হত। খরার হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকার প্রথমে জাপান থেকে পরে চীন থেকে সেচ যন্ত্র আমদানী করা শুরু করে, ফলে শুষ্ক মৌসুম ও খরার বছরে সেচের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন অব্যহত রাখা সম্ভব হয়। বর্তমানে কৃষি উৎপাদনে দেশ অনেকাংশে স্বর্নিভর। আমাদের দেশের উত্তরে ভারত, নেপাল, ভুটান, চীনের কিয়দাংশ এবং সু-উচ্চ হিমালয় পর্বত অবস্থিত। হিমালয়ের বরফ গলা পানির সাথে উজানের বৃষ্টির পানি আমাদের দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদী দিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই দক্ষিণে বঙ্গপোসাগরে পতিত হয়। শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপে পাকিস্তান আমলে আমরা যেমন কর্ণফুলী নদীর উপর বাঁধ দিয়ে কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তুলেছি। বিদ্যুৎ মানুষের আরাম-আয়েশ বাড়িয়ে দিয়েছে, তেমনি কাপ্তাই বাঁধ রাঙ্গামাটির জীববৈচিতের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আবার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য আমরা পদ্মা সেতু, যমুনা সেতু, গোমতি, ধলেশ্বরী সেতু সহ প্রায় সকল নদীর উপর সেতু নির্মাণ করেছি। ফলে যাতায়াত ব্যবস্থায় উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু, নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মত সেতু নির্মাণের পর নদীগুলো নব্যতা হারিয়েছে। যমুনা সেতুর উভয় পার্শ্বে চর পরেছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, কিছু দিন পর সেতু দেখতে পাব, নদী খুঁজে পাবনা। অতি সম্প্রতি সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ তার এলাকার জন্য হাওড়ের মধ্যে দিয়ে দৃষ্টিনন্দন রাস্তা তৈরী করে প্রভূত সুনাম অর্জন করেছেন। কিন্তু, কিছু দিন যেতে না যেতেই বন্যার সময় বিপত্তি ঘটল। দেখা গেল দৃষ্টিনন্দন সেই রাস্তা বন্যার পানি হাওড় থেকে নেমে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করল। ফলে হাওড়ের জীববৈচিত্র ও পরিবেশেকে ব্যহত করল, আবার বন্যায় কৃষির ক্ষতি করল। আমাদের উজানের দেশ ভারত, এমনকি চীনও আমাদের দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত আর্ন্তজাতিক নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সহ পানি প্রত্যাহার করছে। তারা যেমন আমাদের সাথে সু-প্রতিবেশীর মতো আচরণ করেনি, আমাদের ক্ষতি সাধন করেছে। তেমনি আমাদের প্রতিবাদ করতে না পারা জাতি হিসাবে আমাদের জন্য লজ্জার। অর্থনৈতিক, সামরিক এমকি রাজনৈতিক ভাবেও আমরা পার্শ্ববর্তী দেশের উপর নির্ভশীল। তাই আমরা আমাদের অধিকার রক্ষা করতে শুধু ব্যর্থই হইনি, বরং যখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিল তারা ব্যক্তিক বা দলীয় স্বার্থে র্নিলজ্জভাবে জাতীয় স্বার্থ অন্যের কাছে বিকিয়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করেনি। এই কাজে রানৈতিক দলগুলো যতনা অগ্রগামী ছিল প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের চাটুকারীতা তার থেকে ঢ়েড় বেশী ছিল। যার ফলে প্রায় প্রতিটি আর্ন্তজাতিক চুক্তি আমাদের জাতীয় স্বার্থের বিপক্ষে গিয়েছে। গণ-আন্দলোনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত অন্তবর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা শুধুমাত্র একটি গ্রহণ যোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানই নয় তার থেকেও বেশী। জানতে পারলাম মাননীয় উপদেষ্টা, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব তলব করেছেন। আমরা বিনয়ের সাথে প্রত্যাশা করছি, বিষয়টি যেন অতীত রাজনৈতিক সরকারের কথার কথা না হয়। আমরা দেশবাসী প্রত্যাশা করছি প্রথমে মাননীয় উপদেষ্টামন্ডলী তাঁদের হিসাব বিবরণী জমা দেওয়া সহ প্রকাশ করবেন। তার পর প্রজাতন্ত্রের কর্মেনিযুক্ত সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সম্পদের হিসাব বিবরণী তলব করে একটি নজির সৃষ্টি করবেন। যাতে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারগুলো মনে রাখে, ঐ চেয়ারে মাননীয় উপদেষ্টাাগাণ বসেছিল।
ভারতের সেভেন সিস্টারের এক সিস্টার ত্রিপুরা। আমাদের ভূ-ভাগের উজানে অবস্থিত। ভারত ত্রিপুরায় গমতি নদীর উপর ডাম্বুর বাঁধ র্নিমাণ করায় সেখানে বিশালাকার জলাধারে পানি ধারণ করে ৪০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিপাতে জলাধার যখন পানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তখন আমাদেরকে কোন প্রকার পূর্ব সর্তকতা ছাড়াই ডাম্বর বাঁধ খুলে দেওয়ায় গোমতি নদীর পানির প্রবাহ বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী সহ অনেক জেলায় বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। মানুষ ত্রাণ সহায়তার চেয়ে বাচাঁর জন্য আকুতি জানিয়েছে বেশী। ভারতের এরূপ অমানবিক আচরণে আমরা ক্ষুব্ধ। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ভারতীয় হাইকমিশনার এর কাছ বন্যার কারণ ব্যাখ্যা চেয়েছেন। ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আমাদের প্রবাসীভাই সহ অনেকেই ভারতের আগ্রাসী থেকে দেশ বাচাঁতে বাঁধ র্নিমানের পরামর্শ সহ দাবী জানিয়েছে। আমাদের দেশে ঢাকা শহর রক্ষার জন্য ব্যারিবাঁধ আছে, যমুনা ও তিস্তার বন্যা থেকে রক্ষার জন্য বাঁধ দেওয়া হয়েছে, রাজশাহী শহর রক্ষার জন্য পদ্মা নদীতে বাঁধ দেওয়া সহ আনেক বাঁধ র্নিমাণ করা হয়েছে। কিন্তু, সে বাঁধগুলো সবই নদী শাসনের জন্য। কিন্তু, উজানে অবস্থিত ভারতের পানি আগ্রাসন থেকে বাঁচতে দেশের চর্তুর পাশে উচুঁ দেয়ালের মত বাঁধ র্নিমাণ করে পানি আগ্রাসন ঠেকানো বাস্তবে সম্ভব কিনা? গোমতী নদীতে বাঁধ দিয়ে রক্ষা পাওয়া যাবে কিনা? তা চিন্তার বিষয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত থেকে প্রবাহিত নদীগুলোর তলদেশ খনন করে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি ও নাব্যতা ফিরিয়ে আনাই বেশী জরুরী। একই সাথে বাছ-বিচার না করে রাস্তা, সেতু র্নিমাণে সতর্ক হতে হবে। যাতে উজান থেকে নেমে আসা পানি বাঁধাহীনভাবে দক্ষিণের সাগরে নেমে যেতে পারে। একই সাথে আমাদের আবহওয়া অধিদপ্তরকে লাল ফিতার দৌড় থেকে বেরকরে, প্রোএ্যাক্টিভ করতে হবে। যাতে আমাদের ভারত নির্ভরশীলতা কমে।
লেখকঃ সমাজকর্মী ও অ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট