পর্ব – ১৯
মেঘ সরে গেছে চাঁদ নেই। দু’ চারটে তারা ফুটেছে আকাশে। অনেকটা জল ঝরিয়ে আকাশে দুপুরের গুমোট ভাব আর নেই। দিনের বেলার তাপও কোথায় উধাও। তবে বাতাস বেশ জোরেই বইছে। দিশাহীন ভাবে। ঝাপটা দিচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ। সামনে শুনশান রাস্তা। আশেপাশের বিল্ডিং এর আলোর কুচি ভারী নরম এক আভা ছড়িয়েছে জলে। বৃষ্টি ধোয়া গাছপালা সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। বুনো বুনো। সুখ মাখানো। একটা মোটর সাইকেলে চেপে বসেছি। কখন যে ফার্মগেট পার হয়েছি টেরই পাইনি। মেঘলা আকাশ, মায়া ছড়ানো আলো খুব একটা ভিড় ভাট্টা নেই। সাঁই করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল মালুমই হল না। অন্য সময় হলে হয়তো গাল পাড়তাম। হৃদয়ের অস্থিরতা বুঝি অনেক স্বাভাবিক অনুভূতিকেও অসাড় করে দেয়। মোটর সাইকেল ওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। ঘুরে একবার দেখে নিলাম আশপাশ। আবছা দুলে গেল স্মৃতি। পা যেন সহসা অবশ। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে এগোলাম আবার। গলির ভেতর অন্ধকার। অনেকদিন এমন কারেন্ট যায়নি তল্লাটে। বৃষ্টির পর থেকেই আঁধারই আঁধার। পথঘাট বাড়িঘর সবই কেমন আবছায়া মাখা। শুনশান রাস্তায় কেউ নেই। হঠাৎ পাশের কানা গলি দিয়ে একজন বেরিয়ে এলো অশরীরী আত্মার মতো। অনেকটা স্নিগ্ধ বাতাসে ফুসফুসে ভরে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠছি।
আজ সারাদিন কেবল মনে হচ্ছে, কি যেন হারিয়ে ফেলেছি, কি যেন নেই। মনেই করতে পারছি না। কেন যেন মনে হচ্ছে মরে যাব, আচ্ছা যদি আজ রাতে মরেই যাই তাহলে কার কার সাথে আর দেখা হবে না, কেবল মাথায় ঘুরছে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। সারারাত ছটফট করে ভোরের প্রতীক্ষা করছি। এই রাতের নিদ্রাহীন প্রতীক্ষা হাজার বছরের চেয়েও দীর্ঘ মনে হচ্ছে।
ভোরে অহনা অফিসের জন্য তৈরী হচ্ছে তখনই চট করে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। অহনা অফিসের জন্য বেরিয়ে যেতেই একটা অভিমান বুকে চেপে বসল। নিজেকে প্রচন্ড একা অনুভব হতে লাগলো। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়লো দোতলার কার্ণিশে কাক বসে। একটা নয়, একজোড়া। লোকে বলে জোড়া কাক মানে অমঙ্গল। আওয়াজ করে তাড়িয়ে দিতে চাইলাম কিন্তু ঘাপটি মেরে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। কাক দুটোর দুঃসাহস দেখে একটু চমকেছি বটে। ঘড়ির কাঁটায় এখন বোধহয় পৌনে দশটা বাজে। এই সময়ে বাড়ীর ত্রিসীমানায় তো কাক চিল ঘেঁষার কথা নয়। কোন অমঙ্গল তেঁড়েফুঁড়ে আসছে না তো?
ভাবনাটা অবশ্য গেড়ে বসতে পারল না মাথায়। শুধু মনটা আরও একটু আনমনা হয়ে গেল। হাসপাতাল থেকে ফোন এলো। ফোনটা রেখে একটা সিগারেট ধরালাম। হাতে সিগারেট থাকলে মনে যেন একটা বাড়তি আত্মবিশ্বাস আসে।
রাস্তায় নামা মাত্র কোত্থেকে যে একটা দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে এলো বুক বেয়ে? কেনই বা এল? পুরনো কোন ছবি কি দুলিয়ে দিল আমাকে? হাঁটতে হাঁটতে পকেট হাতড়াচ্ছি। নাহ্ নেই সিগারেট। ঢুলুঢুলু চোখে তাকাচ্ছি এদিক সেদিক। চেনা রাস্তা ধরে হাঁটছি। ধীর পায়ে। সুমন গাড়ী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বাসা থেকে বেরোবার দু’মিনিট আগেও প্রবল ক্ষিদে তে নাড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছিল। অথচ এখন পলকে কোথায় ক্ষিদে গায়েব। তাড়াহুড়ো করে রোগীর রিপোর্ট গুলো দেখলাম। শরীরে কেমন একটা জ্বলুনি ভাব লাগছে।
বাসায় ফিরে এলাম। বেসিনে গিয়ে মুখে মাথায় জল চেটালাম তখনি খবরটা শুনলাম, পলকের জন্য বুকটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল। শূন্য ধূ-ধূ ঘাসহীন মাঠের মতো। পরক্ষনে একটা অসহায় রাগ ফুঁসে উঠছে ভেতরে। নিয়তি দেবীর নিষ্ঠুর খেলাটা কেই বা আগে ভাগে অনুমান করতে পারে? শরীরের রোম পলকে খাড়া। মাথা ঝিমঝিম করছে। হঠাৎই শীত করে উঠলো খুব। একা ঘরে গলা বুঁজে আসছিল। ছোট্ট একটা শ্বাস পড়লো। অজান্তেই। ঘোরতর নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে নিজেকে।
কেন কিসের এতো তাড়া ছিলো তার? কেন সে এতো অসময়ে চলে গেল? সম্পর্ক টা ছিঁড়ে গেল বলে তাকেও চিরদিনের মতো চলে যেতে হবে? শেষ দেখা তো আট মাস আগে। আসামির কাঠগড়ায় নত মস্তকে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। ওর উকিলের খোঁচা খোঁচা কথায় ও মাথা তুলিনি। শুধু কোর্ট থেকে চলে যাওয়ার আগে গাঢ় চোখে তার পানে তাকিয়ে ছিলাম একবার, একবারই। এখনও যেন হৃদয়ের গহীন কুঠুরিতে জমে আছে সেই দৃষ্টি। কতকাল যে থাকবে!
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। সামনে এখন অসংখ্য রং ঝিলমিল -ঝিলমিল, আমার চোখে সবই যেন বর্ণহীন সবই যেন নীরস। কেটে যাচ্ছে সময়। আকাশের ছায়াপথের ওপার থেকে কি সে দেখছে আমায়? বুকের চাপ ভাবটা ফিরে এল হঠাৎ। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, যেন কেউ চেপে ধরছে নাক। মুখ দিয়ে বাতাস টানার চেষ্টা করলাম। লাভ হচ্ছে না, দমবন্ধ ভাব বেড়েই চলেছে। মানুষ এক আজব জীব। কখন যে তার মতি পাল্টায়, কীভাবে যে স্রোতের মুখ অন্যদিকে ঘুরে যায়, তা বুঝে ওঠা বড়ই কঠিন। কিছুতেই হিসেব মেলানো যায় না। আমি দাঁড়িয়ে আছি আমার ঘরে। কানের পর্দায় ঘড়ির কাঁটার অস্পষ্ট ধ্বনি। চোখের তারায় ঝাপসা ঝাপসা ছবি। টুকরো টুকরো কথা মনে পড়ছিল। সুখের। দুঃখের। তিক্ততার। আনন্দের। কোন ঝাঁপিতে যে রয়ে গেছিল স্মৃতিগুলো? আশ্চর্য যাকে একদিন বাতিল করেছি, দীর্ঘকাল যার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই, কালে ভদ্রেও তার কথা মনে পড়তো কিনা সন্দেহ, হঠাৎ তার অকালে চলে যাওয়া আমাকে তোলপাড় করে দেয় কোন ম্যাজিকে? এক্ষুনি একটা ভূমিকম্প -টুমিকম্প হলে ভালো হতো কি? এক একটা মুহুর্ত যেন এক একটা দিনের চেয়েও দীর্ঘতর মনে হচ্ছে। সূর্যের গতি সহসা থেমে আছে। সময় কি এগোতে ভূলে গেল? এতোদিন যা ছিল মেদুর স্মৃতি, কখনও অকারণ ঈর্ষার চোরা কামড়। সবই যেন ভোঁতা সহসা। বিবর্ণ।
জন্মালে মরবেই মানুষ কিন্তু হুট করে চলে যাওয়াও তো বিসদৃশ দেখায়। কোত্থেকে আচমকা একরাশ ক্রোধ এসে পুঞ্জীভূত হচ্ছিল আমার পাঁজরে।
কেন এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলে? ঈর্ষা? প্রতিহিংসা পরায়ণতা? ক্ষোভ? পূঞ্জীভূত অভিমান? কার কাছ থেকে দূরে পালাতে চেয়েছিলে তুমি??
খবরটা শোনার পর চিৎকার করে কেঁদেছে অহনা ইচ্ছে করছে তার মতো আমিও কাঁদি। কেন যে কাঁদতে পারছিনা??
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট