পর্ব-৪৬
আধো তন্দ্রায় অহনার ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম । বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না । শেষ রাতে বেশ ভারী বর্ষন হয়েছে । পৃথিবী এখন বেশ শীতল । বেলা অব্দি ঘুরন্ত পাখার নীচে নকশী কাঁথা জড়িয়ে পড়ে থাকতে বেশ লাগছে ।তার ওপর কাল অনেক রাত অব্দি জেগে ছিলাম । ওমা চোখ মেলতেই দেখি এখনো বেশ ভারী বর্ষন হচ্ছে । ভারী বর্ষন মানে পুরো ঢাকা শহরে জল উঠে গেল কোমর অব্দি । ছাদে জল নামার ছিদ্রে পাতা জমে সে জল পাইপ ছুঁইয়ে স্টোরে ঢুকেছে , সেখান থেকে জল ছুঁইয়ে ঘরময় । কেয়ার টেকার আজিজ কে নিয়ে ছাদে গিয়ে সে সব জল সরে যাওয়ার রাস্তা পরিস্কার করে স্টোরের জল পরিস্কার করতে করতে অহনা ছুটল অফিস পানে । বৃষ্টি কমেছে কিন্তু আকাশ এখনো ছাই রঙা ইজেল । স্লেটবরণ ছোপ ছড়িয়ে পুরো আকাশ জুড়েই । রাস্তাঘাটে জল । এক দুঃখী মলিন আলো ব্যেপে আছে চরাচর । তার মধ্যেও অহনা কে অফিস যেতে হচ্ছে । ব্যালকনি দিয়ে তাকিয়ে দেখছি এখন ঢাকায় সকাল দুপুরের দিকে এগুচ্ছে নিজের ছন্দে । মেঘের কারনে গাঢ় আবছায়া , এই আবছায়া কেমন যেন বিষন্নতা চারিয়ে দেয় বুকে । মনে হয় কাজ কর্ম ছেড়ে দিয়ে ঘরের নিরালা কোণে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকি সারাক্ষণ । বৃষ্টি এলেই কেন যে এমন ইচ্ছে জাগে ?? এও কি ক্লান্তির রকম ফের ? সোঁ সোঁ আওয়াজ উঠেছে । জোরে ধাক্কা মারছে হাওয়া । বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘনঘন । বিকট আওয়াজ হল একখানা । কাছে পিঠে কোথাও বাজ পড়ল । শব্দের রেশ কাটতে না কাটতেই আবার একটা । থামতে না থামতেই ফের পিলে চমকানো ধ্বনি । অহনা অফিসে পৌছাতে পারল কি ? আকাশের গুড়গুড় যেন আর থামছেই না । বজ্রপাত ও হচ্ছে মুহুমুহু । অহনা কে ফোনে ধরতে পারছিনা , হয়তো হাত ব্যাগে থাকায় মোবাইলের টোন শুনতে পারছেনা ।
ঢাকা আজ যেন এক বিষন্ন শহর । কয়েক টা জেলায় লকডাউন চলছে । মধ্যবিত্তের এখন ঝিম মারা দশা । অমন একটা ন্যাতানো পরিস্থিতিতে কী যে নাজেহাল দশা মধ্যবিত্তের ! সরকারের কর্তা বাবুদের এখন পাগলা কুকুরের দশা । একে তো নেই কোন কাজের সমন্বয় তার ওপর উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত দিয়ে যাচ্ছে । তাদের মাথার ঠিক নেই । কেউ এসব নিয়ে কথা বললেই যাকে তাকে যখন তখন কামড়াচ্ছে …. হিত অহিত জ্ঞানটাই পুরো লোপ পেয়ে গেছে ।ওই যে কথা আছে না মরণকালে বুদ্ধি নাশ , এ হল গিয়ে সেই ….। লোকজন কী ভয়ানক খেপে আছে এই সরকারের ওপর , সরকার টেরই পাচ্ছে না । নীতি ফীতি ভুলে ডান্ডার জোরে সবাইকে ঠান্ডা করতে চাইছে । এমনিতেই তো এরা পার্টিকে এমন ভাবে সর্বত্র চারিয়ে দিয়েছে , খাস নিজেদের লোক না হলে পিয়ন -বেয়ারার চাকরি মেলাও মুশকিল । সরকারী দলের লোকজন ছাড়া কেউ ভালো নেই । আহা একেই বুঝি বলে কারুর সুখ থই থই , কারুর বা বগলে মই ! আজ আবার কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে । পুরনো একটা উপন্যাসের পাতা উল্টাতে উল্টাতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি ! এই গরমেও শোওয়ার ঘরে এখন আমার আরামই আরাম । ঘোরতর এসি বিরোধী অহনা ও এবার এসি লাগানোতে খুশী । এসি চালিয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়লেই দু’ চোখ জড়িয়ে আসে আমেজে । দুপুর পেরিয়ে কখন যে বিকেল এসে যায় , হুশও যেন থাকেনা তখন ।
আমি আর আমার স্ত্রী দুজনেই কাজ করি। আমি চিকিৎসক আর স্ত্রী একটা গ্রুপ অফ কোম্পানীতে ।জানেন রান্নাও দুজনেই করি বাইরের কাজ ও। আর এর পরে নিজের নিজের দুনিয়াও আছে এবং ওর বন্ধু আমার বন্ধু রা সব এক হয়ে পার্টিও করি। তথাকথিত সংসার কন্সেপ্ট বিলুপ্ত করতে না পারলে পারিবারিক সহিংসতা কিংবা অশান্তির সমস্যা থেকেই যাবে। কন্যা আগে জীবনে প্রতিস্থিতা হোক , চৌদ্দ জন কে রেধে বেড়ে খাওয়াবার দায়িত্ব তার একার নয়, আর সবার খরচ সবকিছুর একটি ছেলের একার দায়িত্ব ও নয়। এইভাবে সব সঠিক নিয়মে চলবে । প্রথাগত সংসার করতে ভালো লাগে না আমার । অহনার বাবা মা রোজ দু’বার তিনবার করে মেয়ের খোঁজ নেয় । আচ্ছা অহনার বাবা মা কি কোন কারণে আশঙ্কিত থাকেন ? না কি এ স্বাভাবিক উদ্বেগ ? বিয়ের পর অহনা উনাদের আশস্ত করার পাশাপাশি কখনও সখনও বকাঝকাও করেছে । সেসব দেখে আমি কেবল হাসতাম । আম্মা এ বয়সেও আমাকে নিয়ে উদ্বেগ উৎকন্ঠায় থাকেন । এখন টের পাই মায়েদের কোন যুগ কাল নেই , হয়তোবা কোনও দেশ ও নেই । ছেলেমেয়েদের বিপন্নতার সামান্যতম সম্ভাবনাও বুঝি মায়েদের কুরে কুরে খায় চিরকাল । এ যেন নিছকই এক জৈবিক অনুভূতি ।
সাড়ে আটটা বাজে । সন্ধ্যা সবে পা ফেলেছে রাতে । প্রায় নির্জন চেম্বারে ঝিম মেরে বসে আছি । চারদিক কেমন শব্দহীন । বাইরে বাসের ভিড় , জন মানুষের গুতোগুতি কিছুই নেই । হাসপাতালের পাশে সবজির ঠেলা নিয়ে মাঝবয়সি এক লোক ধূসর চোখে চারপাশে তাকিয়ে দেখছে । গোটা কয়েক ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধি উদাস ভঙ্গিতে বসে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে । চারদিকে মানুষের উদ্বেগ উৎকন্ঠা । নিজের উদ্বেগও কম নয় , এমন উদ্বেগ নিয়ে কি মন বসানো সম্ভব ? না কোন কিছুতেই মন বসানো যাচ্ছে না । ঢাকা এখন এক বিষন্ন শহর । আসাদ অ্যাভিনিউ ধরে এগচ্ছি টের পেলাম পকেট কাঁপছে থরথর । মোবালটা বের করে অবাক – বহুদিন পর জামালপুরের গির্জার ফাদার ফোন করলেন । “বড় কষ্ট স্যার । এত জ্বালাপোড়া শরীরে …..যেন বিষ ঢুকেছে । সেই তিন বছর আগের মত “ । একটা ফোন মগজে স্মৃতির মৃদু কাঁপন তুলে দিয়ে গেল । কত স্মৃতি জামালপুরে । বৃষ্টি নেমেছে । কাঁচের এপার থেকে জলধারা দেখা যাচ্ছে শুধু , শব্দ শোনা যাচ্ছে না । হাওয়াও দিচ্ছে খুব । রাস্তার সামনের আইল্যান্ডে গাছপালা নড়ছে এলোমেলো । আকাশের যা চেহারা , কখন যে বর্ষন থামবে অনুমান করা মুশকিল । লাউঞ্জের বড় টিভিতে অ্যানিমেল প্ল্যানেট চলছে । রোগীরা বড় বড় চোখে সেদিকে তাকিয়ে । রাস্তায় বাস ট্যাক্সি না চললেও ট্রাক লরী চলে যাচ্ছে , সে সবের ঝমঝম বাজনার মতো শব্দ হচ্ছে চারদিকে । ঝিরঝির বৃষ্টিতে টেলিফোনের তারে বসে আছে কাক । রাস্তার ওপারে তিনতলা বাড়ীটার দেয়ালে রঙবেরঙের পোস্টার , ময়লা স্যাঁতস্যাঁতে ঢাকার রাস্তা ।
বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে আজ । দুপুরে ভাত ঘুমে তন্দ্রা মত এসেছিল , তন্দ্রা ভেঙ্গে দেখি ঘরে কেউ নেই । আম্মা বাসায় এসেছে আজ আঠারো দিন । উঠে ভেতরের ঘরে গিয়ে দেখি বিছানায় নিশ্চল হয়ে বসে আছেন আম্মা । একটু কুঁজো হয়ে কেমন ছেলেমানুষের মতো বসবার ভঙ্গি আম্মার । যেন কোনও কিশোরী বেলার চিন্তায় বিভোর । আম্মা সারাদিন কাঠকুড়ুনির মতো সারা ঘর ঘুরে বেড়ায় । বার বার সামান্য জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করেন অকারনে , তারই ফাঁকে হঠাৎ শূন্য হয়ে যায় চোখ , শিশুর মতো বোকা হয়ে যায় তোবড়ানো মুখ । যেন চারদিকের এই ঘরবাড়ি ,সংসার কোন কিছুর অর্থই আম্মা বুঝতে পারেন না । মাঝে মাঝে ঘুমন্ত অবস্থায় আম্মাকে দেখি , হাঁটু মুড়ে ছোট শিশুর মতো আম্মা ঘুমোয় । নিঃসাড় সে ঘুম । মাঝে মাঝে সেই ঘুমন্ত মুখে একটু খানি হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে যায় । তখন মনে হয় আম্মা স্বপ্ন দেখছেন – সেই কিশোরী বেলার স্বপ্ন ।এক দুর গঞ্জ গাঁয়ের স্বপ্ন , হুগলীর ধনেখালির । জেগে দেখা চারপাশের সাথে যার শত মাইলের তফাত । নাকি বাংলাদেশের বড় সাঙ্গিশ্বরের সেই ধূলো মাখা পথ ! মাটির সোঁদা গন্ধ ! ছেলেবেলায় নজরুল ভাইয়ের পইনিক্স সাইকেলের কেরিয়ারে চেপে কত গেছি সে গাঁয়ে । সে গাঁয়ের মাটিতে অদ্ভুদ এক মায়াবী গন্ধ আছে । আজো খুব মেঘ করে এলে , ব্যালকনিতে বৃষ্টি দেখতে দেখতে সে গন্ধ নাকে লাগে । খালু বড় পুকুরে কিংবা পাশে কুল কুল করে বয়ে যাওয়া খালে জাল ফেলে ধরতেন রুপোলি মাছ , খালার হাতে সে সব মাছের চচ্চরি কী যে অমৃত মনে হত ! কিশোরী শেফালী আপা ধান দিয়ে কিনে দিতেন মুড়ির মোয়া ।আহা কত বছর সে অমৃতের স্বাদ পাইনি ।
ক’দিন খুব বৃষ্টি হচ্ছে । ভাঙাচোরা বিশ্রী রাস্তাটায় খোঁসপাঁচড়ার রসের মতো জল জমে আছে । দু’ ধারে ড্রেন বর্ষার জল পেয়ে ভেতরের আবর্জনা পচে ফুলে আছে । সারারাত ধরে ঝির ঝির বৃষ্টি হয়েই গেল । গাঢ় ঘুম হলোনা । সারা রাত এক অবসন্ন আচ্ছন্নতার মধ্যে বিছানায় পড়ে ছিলাম । ভোরের দিকে আব্বাকে দু’বার স্বপ্ন দেখলাম ।কি ধবধবে সাদা পোষাকে হাসোজ্জ্বল আব্বা । ঘুম ভেঙ্গে গেল । সারারাত যে বৃষ্টির শব্দটা শুনেছি সেটা এখনো হয়েই যাচ্ছে । বুকের মধ্যে দুরদুর করে দ্রুত শব্দ হচ্ছে হৃদপিন্ডের – ঘুম ভেঙ্গে হঠাৎ উঠে বসলে এ-রকম শব্দ হয় , আবার শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে । ঘুমহীনতার জন্য শরীরে জ্বর জ্বর ভাব , মুখের ভিতরে আঠালো লালা , চোখের পাতায় আঁশের মতো জড়িয়ে আছে ঘুম । অবসন্ন লাগছে । লকডাউনের কারনে অহনার অফিস বন্ধ । ব্যালকনির বাইরে এসে বৃষ্টি দেখছি , বৃষ্টি ধুয়ে দেয়া বাতাস বইছে । বাতাস এখন বড় পবিত্র , বড় উদার । শুন্য অলিগলি রাস্তাঘাট । সামনে আকাশ , সে আকাশ মেঘে ঢাকা শ্লেট বর্ণ । বৃষ্টি হলে চোখ বুজলে মনে হয় গ্রামের বাড়ীর উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি । মনে পড়ে দল বেঁধে বাড়ীর সামনের পুকুরে দাপাদাপি করতাম বৃষ্টি হলেই , অতি বৃষ্টিতে বাড়ীর পেছনের জমি গুলোয় পানি থই থই । জাল নিয়ে সে জলে মাছ ধরতে নেমে যেত কেউ কেউ । ক্রমে ক্রমে সবকিছুই আবছা হয়ে গেছে । আম্মা এলে গল্প করেন । গাছগাছালির গল্প , বাড়ীর পেছনের ছোট পুকুরের মাছেদের গল্প , পিঠে- পায়েসের গল্প । আম্মা যখন গল্প করেন তখন তাঁর গলায় জল-মাটির নোনা আর সোঁদা গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে যায় ইট কাঠের এই ব্যস্ত শহরের আমার ছ’তলার ফ্ল্যাট জুড়ে ।
মেঘ রঙা ইজেল মাখা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ে ,ছেলেবেলায় খেলার শেষে ফাঁকা মাঠে শুয়ে থেকে কত দিন আকাশ দেখতাম । সে আকাশ দেখতে দেখতে কোন এক শূন্যতায় যে পৌছে যেতাম ! পার্থিব কোন কিছু আর মনে থাকত না , বিপুল আকাশ -চেতনা আচ্ছন্ন করে রাখত , শুন্যের বিষন্নতায় ডুবে থাকতাম । এখন আমার চারপাশের বিষন্নতা ,বয়স হওয়া আমায় শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে , আকাশের বিষন্নতা এখন আর তেমন একটা কিছুই মনে হয়না । বহুকাল পর আজ মাথার ভিতরটা ফাঁকা লাগছে । স্পষ্ট টের পাচ্ছি মাথার ভিতর আকাশের একটা অংশ যেন ঢুকে আছে । বেরোচ্ছে না । যেন কোন সুদূর থেকে আকাশের শূন্যতা তুষারপাতের মতো নিঃশব্দে আমার মাথার ভিতরে খসে পড়ছে । মাথার মধ্যে চমৎকার নীলাভ আকাশখানা আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছে । মাথার ভিতর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সব চিন্তা , স্মৃতি , ক্ষোভ ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট