মজিব রহমান
গরীবকে পইপই করে শেখানো হয়, যদি কপালে লেখা না থাকে তবে তুমিতো অর্থের মালিক হবা না, যতই চেষ্টা করো। এটা ভাগ্যের বিষয়, স্রষ্টার লীলা। তিনি তাঁর পছন্দের বান্দাদের দরিদ্র করে রাখেন, হিসাব কম দিতে হবে বলে। অথচ গরীব জানেও না অর্থ কি? কিভাবে কাজ করে? আধুনিক সময়ে বলতে হয় কোনো পণ্য ক্রয় বা বিক্রয় করার উপাদান হল অর্থ। এর সাথে সেবা গ্রহণ-প্রদান বা ঋণ গ্রহণ-পরিশোধ এর উপাদানও। অর্থকে আমরা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবেই ধরে নিয়েছি। এখন টাকা পয়সা হল অর্থ। একসময় কড়ি বা পাথর ছিল বিনিময় মাধ্যম তখন এগুলোও ছিল অর্থ। এখন গ্রামের ছোট্ট শিশুও জানে যে, টাকা হচ্ছে এমন জিনিস যা দিয়ে জিনিস-পত্র কেনা যায়। কিন্তু শিশুটি জানে না, টাকা কোথা থেকে আসে? কেন তার দরিদ্র বাবা এতো কাঁদলেও চিপস কেনার জন্য ১০টি টাকা দিতে চায় না? অভিমানে সে ভাবতে থাকে, কেন তার বাবার কাছে অনেক টাকা নেই? কেন ঝিলমিলের বাবার কাছে অনেক টাকা আছে? অথবা সে ভাবতে পারে, দোকানদার কেন তাকে ফ্রি চিপস দেয় না?
টাকা আসলে একটা ক্ষমতা। (একজন টাকাওয়ালা গ্রামের ৪০ জন সরকারি দলের নেতা-পোতাকে নিয়ে থানায় গেলেন। গিয়েই ওসি সাহেবের গালে চটাস করে থাপ্পর মারলেন। ওসি সাহেব, বিস্মিত হয়ে বললেন, স্যার কি অপরাধ করেছি? টাকাওয়ালা বলল, আমার সখের মুরগি খাটাসে নিয়ে গেছে। ওসি সাহেব ডিউটি অফিসারকে ডেকে চটকানা মেরে প্রতিশোধ নিয়ে বললেন, যা ওনার গ্রামে গিয়ে গোটা দশেক বিরোধী দলের মুরগী চোরকে ধরে নিয়ে আয়, টাকা আসবে। এই হল টাকার ক্ষমতা। বি.দ্র.: এটুকু স্রেফ স্যাটায়ার। কেউ সত্য ধরে নিবেন না।) আমাদের জানা দরকার জিনিসটার এতো ক্ষমতার উৎস কোথায়?
জিনিস নিয়েও আমাদের কম বিস্ময় নয়। আমরাতো সুন্দরী মেয়েকেও জিনিস বলি। আমাদের সময় বলা হতো, আহা ঐশ্বরিয়া কি জিনিস! এখন বলে, সাকিব আল হাসান কি জিনিসরে দেখলি? আবারো ৫ উইকেট! আর্জেন্টিনিদের কাছে মেসি হল জিনিস! অন্যরা বলবে, আরে এখন জিনিস থাকলে সে হল, এমবাপ্পে! বাস্তবিক মানুষ শ্রম দিয়ে যা কিছু তৈরি করে, তাই জিনিস! কিন্তু ঐশ্বরিয়া, সাকিব, মেসি, রোনাল্ডু, এমবাপ্পে তো প্রাকৃতিক। মানুষ তাকে জন্ম দিয়েছে, শ্রম দিয়ে বড় করেছে এরপর আরো শ্রম দিয়েই আজকের অবস্থানে নিয়েছে। এরপরও এগুলো কিন্তু জিনিস নয়। চাপাইর হিমসাগর আর আটলান্টিক মহাসাগর সবই প্রাকৃতিক বস্তু। কিন্তু গরিবের কাছে এসবই জিনিস। তাদের জীবনটাই এমন ভুলে ভরা। আমাদের মা-চাচীরা স্বর্ণলঙ্কার বলতেন না, বলতেন জিনিস। এটা আবার ঠিক বলতেন৷ টাকা যেহেতু উদ্ভিদ ও পলিমারসহ বিভিন্ন কাচামাল থেকে মানুষই তৈরি করে তাই এটি অবশ্যই একটা জিনিস। এই জিনিসটা হঠাৎ কিভাবে আসে তার দুটি উদাহরণ দেই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে-
০১। নারায়ণগঞ্জে এক ভদ্রলোকের আলিশান বাড়িতে গিয়েছিলাম এক বন্ধুর সাথে। তিনি জানালেন, নারায়ণগঞ্জ সদরে নিজের তিনটি বাড়ি আছে। সামনের মসজিদটিও তিনি বানিয়েছেন। কথায় কথায় জানালেন, স্রষ্টা ওয়াদাবদ্ধ যে, স্বর্গে তার জন্যও একটি ঘর বানিয়ে দিবেন! কিন্তু আমার মনে ভাবনা ওনি এতো টাকার মালিক হলেন কি করে? অনেকদিন পরে মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরে এক গৃহকর্মীর সন্ধান পাই যার সম্বলহীন নিরুদ্দেশ স্বামীর নামে কয়েক কোটি টাকা খেলাপী ঋণের মামলা রয়েছে। অনুসন্ধানে জানতে পারি, ওই গৃহকর্মীর স্বামী ধলেশ্বরী নদীর মাঝি ছিলেন। এক ব্যাংক ম্যানেজারকে নিয়মিতই পারাপার করতেন। আবার সুন্দরী দেখে যৌনকর্মীও এনে দিতেন। এই সম্পর্কের জের ধরেই ম্যানেজার তাকে ৫০০ টাকা পাইয়ে দেয়ার জন্য অনেকগুলো কাগজে সই নিয়েছিলেন। কয়েক বছর পরে জানতে পারেন, তাকে ধরার জন্য পুলিশ খুঁজছে এবং ব্যাংক তার কাছে কয়েক কোটি টাকা পাবে। তিনি স্ত্রী ও কন্যাকে রেখে পালিয়ে যান উত্তরবঙ্গের কোথাও। আর কোন খোঁজ পাননি। এমন বেশ কয়েকটি ঘটনার পরিণতি হল ওনার আলিশান তিনটি বাড়ি।
০২। গতকাল নবাবগঞ্জ-কলাকোপায় পরিচিত হলাম হিন্দু সম্প্রদায়ের এক প্রবাসীর সাথে। তিনি জানালেন, বিদেশ থেকে এসে বাড়ির পাশে একটি জমি কেনার জন্য ব্যাংক থেকে ৪০ লক্ষ টাকা তুলে ঘরে রেখেছিলেন। পরদিন জমি রেজিস্ট্রি। স্ত্রী রাতের বেলাতেই সকল টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। তিনি মামলা করতে যান থানায়। বিভিন্ন প্যাচে পড়ে জিডি করতে সক্ষম হন। তার শ্বশুর-শাশুড়ী হাতে পায়ে ধরে মিনতি করে— যেন তাদের নামে মামলা না করে। মেয়েকে টাকাসহ ফিরিয়ে এনে দিবেন। ঘরে টাকা পয়সা নাই বলে মেয়েকে খোঁজার জন্য ৫ হাজার টাকাও নিয়ে যান। সেই টাকা দিয়েই তিনি মেয়েকে গুমের মামলা দেন। তিনি গ্রামের কয়েকটি মসজিদে টাকা দিয়েছিলেন। মুছুল্লিরাই দেখেছিল যে, মেয়েকে ভোর রাতে মেয়ের বাবা ও মা মিলে সিএনজিতে মেয়েকে ছেলেসহ সিএনজিতে করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাতে তিনি মামলা থেকে রক্ষা পেয়েছেন। তিনি জানতে পেরেছেন স্ত্রীকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
কিছু মানুষ তিল তিল করে টাকা জমায় আর এভাবেই অন্য কিছু মানুষ হঠাৎ অনেক টাকার মালিক বনে যায়৷ টাকার শক্তিতে তারা সব অপরাধ ধামাচাপা দেন৷ হ্যাঁ সত্যিই টাকা এমনই শক্তিশালী জিনিস!